চণ্ডীবাবু বলে উঠলেন, তাহলে বাসন্তীর কথাই ঠিক। ওই লোকটা সেই একচোখে বজ্জাত ভুতু।
গোয়েন্দাপ্রবর হাসতে-হাসতে বললেন,–এক্কেরে মানানসই। ভূতের নাম ভুতু হইলে সে মানুষ-ভূত। হ্যাঁ, যে লোকটা তারে দেখা করতে আইসিল, তার চেহারা ভদ্রলোকের মতন। কিন্তু তার গোঁফখানা দেইখ্যা মনে হইসিল, লোকটা দাগি আসামি। ওই যে কথায় আসে না, শিকারি বিড়ালের গোঁফ দেখলে চেনা যায়! ওইরকম গোঁফ ভদ্রলোক রাখে না।
কর্নেল বললেন,–ঠিক আছে, আপনি পুলিশের সামনে যেন মুখ ফসকে এসব কথা বলবেন না।
চণ্ডীবাবু বললেন, আমার খুব অবাক লাগছে। বাসন্তী তাহলে ঠিকই সন্দেহ করেছিল। দ্বিতীয় লোকটার নাম গোপেন। ওর বাবাকে লোকে বলত পোড়াসিংঘি। কারণ, ওর বাবা গোপাল সিংহের মুখের একটা পাশ ছোটবেলায় পুড়ে গিয়েছিল। কেউ-কেউ অবশ্য পোড়া কায়েতও বলত। তার ছেলে গোপেন যে গুণ্ডামি করে বেড়াবে, এমনকি ডাকাত দলেও নাম লেখাবে, এটা কেউ কল্পনা করতেও পারেনি।
কর্নেল বললেন, আপনারা শচীনবাবুকে এসব কথা যেন বলবেন না। দরকার হলে আমি শচীনবাবুর সঙ্গে কথা বলে ওই লোকদুটোর সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বতার কারণটা খুঁজে বের করব।
চণ্ডীবাবুর বাড়ি পৌঁছুনোর পর হালদারমশাই সোয়েটার এবং প্যান্টের কাদা পরিষ্কার করতে বাথরুমে ঢুকলেন। চণ্ডীবাবু দোতলায় নিজের ঘরে চলে গিয়েছিলেন। শুধু কার্তিক আমাদের অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছিল। সে বলল,–সায়েবরা এবার নিশ্চয়ই কফি খাবেন?
কর্নেল বললেন, হ্যাঁ, এক কাপ কফি পেলে ভালো হয়।
কার্তিক চলে যাওয়ার পর কর্নেল চাপাস্বরে বললেন,–জয়ন্ত, এখন তোমার কী মনে হচ্ছে, আমাকে খুলে বলো।
একটু ভেবে নিয়ে বললুম,–আমার মনে হচ্ছে, মহীনবাবুকে কোথাও ওই ভুতু আর গোপেন মিলে জোর করে আটকে রেখেছে। তার ওপর অত্যাচার করে পূর্বপুরুষের লুকিয়ে রাখা সোনার মোহর ভর্তি ঘড়া কোথায় আছে, তা জানার জন্যে ওরা চেষ্টা করছে। আর শচীনবাবু সম্ভবত সেই সোনার মোহরের লোভে ওদের ফাঁদে পা দিয়েছে।
কর্নেল বললেন, তাহলে শচীনবাবু চণ্ডীবাবুর কাছে পরামর্শ চাইতে গিয়েছিলেন কেন? আর যদি বা গেলেন, তিনি চণ্ডীবাবুর মুখে আমার পরিচয় পেয়েই গিয়েছিলেন। এক্ষেত্রে তার মতো একজন খোঁড়া মানুষ এতটা ঝুঁকি নেবেনই বা কেন?
এই সময়েই চণ্ডীবাবু ঘরে ঢুকে বললেন,–কফি আসছে। আর যার জন্য কর্নেল সাহেব মনে-মনে অপেক্ষা করছিলেন, সেই শচীনও তার গাবদা মোটা ছড়িটা নিয়ে গেটে ঢুকছে দেখলুম।
কর্নেল বললেন,–বাঃ, সুখবর। তবে আপনি কফি খেয়েই কাজের অছিলায় এ-ঘর থেকে যেন কেটে পড়বেন।
.
ছয়
শচীনবাবুকে কার্তিক আমাদের ঘরে পৌঁছে দিয়ে গেল। ঘরে ঢুকে শচীনবাবু নমস্কার করে বললেন,–পিসিমার মুখে শুনলুম আপনারা আমাদের বাড়ি গিয়েছিলেন। আমি একটুখানি বাজারের দিকে গিয়েছিলুম। পিসিমার মুখে শুনেই সাইকেলরিকশাতে চেপে চণ্ডীবাবুর বাড়িতে এলুম। দারোয়ান বললেন, হ্যাঁ, কর্নেলসাহেবরা কিছুক্ষণ আগে ফিরে এসেছেন।
চণ্ডীবাবু বললেন,–বসো শচীন। তোমার জন্যে এক কাপ কফি পাঠিয়ে দিচ্ছি।
শচীনবাবু বললেন,–না কাকাবাবু, এইমাত্র আমি বাজারে চা খেয়ে-খেয়ে মুখ তেতো করে ফেলেছি। আর কিছু খাব না।
চণ্ডীবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,–ঠিক আছে। তাহলে তোমরা কথাবার্তা বলো। আমার একটা জরুরি কাজ আছে। কাজটা সেরে নিয়ে আবার আসব।
তিনি চলে যাওয়ার পর কর্নেল বললেন, আপনাদের বাড়িতে যে ভূতের উপদ্রব শুরু হয়েছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। দিন-দুপুরে পাঁচিলের ওপর দিয়ে কালো কুচ্ছিত একটা বিদঘুঁটে মুখ উঁকি দিচ্ছিল। আমি তাড়া করে যেতেই অদৃশ্য হল।
শচীনবাবু গম্ভীর মুখে বললেন,–কথাটা পিসিমার কাছে শুনে এলুম। আমার মনে হচ্ছে কলকাতা থেকে আপনার মতো খ্যাতিমান রহস্যভেদী সদলবলে এখানে এসে পড়েছেন, তাই ছোটকাকার খুনিরা মরিয়া হয়ে উঠেছে।
হালদারমশাই তার সোয়েটার আর প্যান্টের কাদাগুলো জল দিয়ে আলতোভাবে সাফ করে কফির আসরে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি বললেন, আপনাগো বাড়ির লগে একখান বাঁশঝাড় আছে।
শচীনবাবু চমকে উঠে বললেন, হ্যাঁ আছে। কিন্তু আপনি কি সেখানে সন্দেহজনক কিছু দেখেছেন?
হালদারমশাই কী বলতে যাচ্ছিলেন, কর্নেল তাকে থামিয়ে বললেন,–ওসব কিছু না। আপনি আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিন।
শচীনবাবু বললেন,–নিশ্চয়ই দেব। আমি যা যতটুকু জানি সব বলব।
কর্নেল বললেন,–গোপেন আর ভুতু নামে দুটো লোক আপনার কাছে নাকি আড্ডা দিতে আসত।
শচীনবাবু চমকে উঠে বললেন,–পিসিমা বলেছেন? আসলে কী হয়েছে জানেন, ওরা দুজনেই এলাকার নামকরা বজ্জাত। শুধু বজ্জাত বললে ভুল হবে, ওরা না-পারে এমন কাজ নেই। কিন্তু আমার স্কুললাইফে ওরা দুজনেই আমার সহপাঠী ছিল। সেই সূত্রে রাস্তাঘাটে দেখা হলে কথাবার্তা বলেছি। কিন্তু সম্প্রতি কিছুদিন থেকে ওরা একরকম জোর করেই আমার ঘরে ঢুকে আড্ডা দিত। বাধ্য হয়ে পিসিমাকে বলে ওদের চা খাওয়াতে হতো। তারপর ক্রমে-ক্রমে বুঝতে পারলুম, আমার কাছে ওদের আসার একটা উদ্দেশ্য আছে। আমার ধারণা হয়েছিল সম্ভবত সরল সাদাসিধে সন্ন্যাসীটাইপ মানুষ আমার কাকা হয়তো কথায়-কথায় ওদের কাছে জানিয়ে দিয়েছেন, আমাদের পূর্বপুরুষের একঘড়া সোনার মোহর কোথায় পোঁতা আছে, তার খবর তার জানা।