বুঝতে পারলুম এই দরজা দিয়ে মন্দির এবং চত্বরের নীচে পুকুরের ঘাটে যাওয়া যায়। বাড়ির ভেতরে ঢুকে দেখলুম, একতলা একটা পুরোনো বাড়ি। অন্যপাশে একটা টালির চালের তিনদিক ঘেরা ঘর। ওটা রান্নাঘর।
বাসন্তী দেবী বললেন,–এই সময় আবার শচীন কোথায় বেরুল কে জানে! আপনারা আসুন। শচীনের ঘরেই আপনাদের বসাচ্ছি।
কর্নেল বললেন,–থাক, আমরা বসব না। একটুখানি আপনাদের এই বাড়ি আর পেছন দিকটা ঘুরে দেখব।
কথাটা বলেই কর্নেল হঠাৎ আমাদের অবাক করে রান্নাঘরের পাশে পাঁচিলটার দিকে দৌড়ে গেলেন। তারপর পাঁচিলের ওপর দিয়ে দু-হাতের সাহায্যে উঁচু হয়ে কী দেখলেন। তারপর ফিরে এসে সহাস্যে বললেন,–দিন-দুপুরে পাঁচিলের ওপর দিয়ে ভূতের মুণ্ডু!
চণ্ডীবাবু বললেন,–ভূতের মুণ্ডু মানে! কেউ উঁকি দিচ্ছিল?
কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। কুৎসিত মুখোশ পরা একটা মুখ! আমি তেড়ে যেতেই অদৃশ্য। অগত্যা দৌড়ে গিয়ে দেখতে হল ভূতের চেহারাটা কীরকম। কিন্তু ততক্ষণে ভূতটা পেছনের ওই ভেঙেপড়া বাড়িটার আড়ালে লুকিয়ে গেল।
বাসন্তীদেবী চোখ বড় করে বললেন,–এত সাহস! কর্নেসাহেব দয়া করে একটু বসুন।
.
পাঁচ
বাসন্তী দেবীর অনুরোধে কর্নেল বললেন, ঠিক আছে, যদি আপনার কোনও কথা বলার থাকে, এখানে দাঁড়িয়েই বলতে পারেন।
বাসন্তী দেবী বললেন,–দাদা এখন বাথরুমে আছেন। তা না হলে দাদাই বলতেন। ছোড়দা মহীন প্রায়ই বলত, সে আমাদের পূর্বপুরুষের লুকিয়ে রাখা এক ঘড়া সোনার মোহর কোথায় আছে তা জানে, কিন্তু সেকথা সে জানাতে পারবে না। কারণ, এক রাত্রে স্বপ্নে তাকে তার ঠাকুরদা নাকি দেখা দিয়ে বলেছেন, তুই যা জেনেছিস তা যেন অন্যে জানতে না পারে। অন্যকে তুই মোহরের ঘড়ার খবর দিলে মুখে রক্ত উঠে মরবি। তাই আমাদের ঠাকুরবাড়িতে হাড়িকাঠের পাশে রক্ত দেখার সঙ্গে-সঙ্গেই আমার মনে হয়েছিল তাহলে মহীনই হয়তো শচীনকে কথাটা বলে দিয়েছিল। তাই মুখে রক্ত উঠে সে মরেছে। আর শচীন তার লাশটা তুলে কোথাও পুঁতে ফেলেছে।
চণ্ডীবাবু বলে উঠলেন,–কী সর্বনাশ! উনি ওই গোবেচারা শচীনকেই সন্দেহ করে ফেললেন? শচীনের মতো রোগাটে গড়নের লোক তার কাকার লাশ একা ওঠাতে পারে?
বাসন্তী দেবী বিব্রত মুখে বললেন,–না, মানে আমি ভেবেছিলুম শচীনের সঙ্গে তার বন্ধুরাও হয়তো ছিল।
চণ্ডীবাবু হো-হো করে হেসে উঠলেন। কর্নেল বললেন, আপনি কি আপনার বড়দাকে একথা বলেছিলেন? কিংবা কোনও ছলে শচীনকেও এরকম কোনও আভাস দিয়েছিলেন?
বাসন্তী দেবী বললেন,–না, কথাটা আমি কাকেও বলিনি। এমন কথা কি বলা যায়? কর্নেল বললেন, তখন আপনার এরকম ধারণা হয়েছিল, এখন আপনার কী ধারণা? বাসন্তী দেবীর কান্না এসে গেল। আত্মসম্বরণ করে বললেন, আমার ছোড়দার মতো সন্ন্যাসী সাদাসিধা মানুষকে খুন করার পেছনে আর কী কারণ থাকতে পারে, এবার আপনারাই বলুন। আমার মনে হচ্ছে নিশ্চয়ই সে দৈবাৎ মুখ ফসকে কোনও দুষ্ট লোককে কথাটা বলে ফেলেছিল। তারপর অভিশাপ লেগে ছোড়দা মুখে রক্ত উঠে মরেছে। তবে আমি কিন্তু আমাদের বাড়ির চারপাশে সব জায়গা তন্নতন্ন করে খুঁজেছি, কোথাও কোনও গর্ত খোঁড়া দেখতে পাইনি। তবে এমনও হতে পারে মোহর ভরতি ঘড়া এর বাইরে কোথাও পোঁতা ছিল।
চণ্ডীবাবু বললেন, পুলিশ তো এই এলাকা তন্নতন্ন খুঁজেছে, যদি কোথাও মহীনকে পুঁতে রাখা হয় তার খোঁজ মিলবে। কিন্তু তেমন কোনও চিহ্নই তারা পায়নি।
এই সময়েই বারান্দার ওপাশে বাথরুম থেকে এক রুণ চেহারার ভদ্রলোক বেরিয়ে আসতেই বাসন্তী দেবী হন্তদন্ত গিয়ে তাকে ধরলেন। বললেন,–সাড়া দিলেই তো আমি যেতুম।
ভদ্রলোকের চেহারায় শচীনবাবুর ছাপ স্পষ্ট। উনি তাহলে শচীনবাবুর বাবা অহীনবাবু। বাসন্তী দেবীর কাঁধে ভর দিয়ে একপা-একপা করে এগিয়ে এসে তিনি ঘরের দরজার কাছে দাঁড়ালেন। বললেন, কারা যেন বসে আছে।
বাসন্তী দেবী বললেন,–চণ্ডীদা এসেছেন। আর তার সঙ্গে কলকাতার সেই কর্নেলসাহেবরা এসেছেন। যাঁদের কাছে শচীন গিয়েছিল।
অহীনবাবু ছেলেমানুষের মতো কেঁদে উঠলেন। বললেন,–আমার সাদাসিধে সরল ভাইটাকে কারা মেরে ফেলল।
চণ্ডীবাবু উঠে গিয়ে তাকে ধরে বললেন,–ঘরে চলুন। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে আপনার কষ্ট হবে।
চণ্ডীবাবু এবং বাসন্তী দেবী অহীনবাবুকে ঘরে তার বিছানায় শুইয়ে রেখে বাইরে এলেন। সেই সময়েই কর্নেল বাসন্তী দেবীকে বললেন,–একটা কথা আমার জানতে ইচ্ছে করছে। শচীনবাবুর একটা পায়ে গণ্ডগোল আছে। আমি লক্ষ করেছি, উনি মোটা ছড়ির সাহায্য ছাড়া হাঁটতে পারেন না।
বাসন্তী দেবী বললেন,–ওঁর বাঁ-পায়ের পাতা জন্ম থেকেই একটু বাঁকা। তাই ছোটবেলা থেকেই খুঁড়িয়ে হাঁটত শচীন। স্কুল যেত একটা মোটাসোটা বেতের ছড়িতে ভর দিয়ে। ছাত্ররা ওকে খোঁড়ামাস্টার বলে আড়ালে ভেংচি কাটত।
চণ্ডীবাবু তখনই হাসতে-হাসতে বললেন,–বেচারা খোঁড়া মাস্টারের ওপর তুমি সন্দেহ করে ভেবেছিলে, সে নাকি তার কাকার লাশ গুম করেছে!
বাসন্তী দেবী জিভ কেটে বললেন,–না-না, মানে ওর দু-একজন বন্ধু আছে, তারা তো ভালো লোক নয়। তুমি তাদের চেনো চণ্ডীদা। কায়েতপাড়ার গোপেন আর ওই যে একচোখা লোকটা–কী যেন নাম। সদগোপপাড়ায় বাড়ি
চণ্ডীবাবু বললেন,–ভুতুর কথা বলছ?