কর্নেল বললেন,–হালদারমশাই এখানকার ঠান্ডায় একেবারে নেতিয়ে গেছেন। তাই শরীর গরম করার জন্য তিনি পায়ে হেঁটে সারা কালিকাপুর ঘুরে দেখতে চান। এতে নাকি তার শরীর আবার গরম হয়ে উঠবে।
প্রণবেশবাবু হেসে উঠলেন। বললেন,–পায়ে হেঁটে কালিকাপুর পুরোটা ঘুরে দেখতে দুপুর গড়িয়ে যাবে। যাই হোক, এবার একটা সিরিয়াস কথায় আসছি। শচীনবাবু কাল সন্ধ্যায় থানায় এসেছিলেন। উনি বলেছিলেন ওঁর বাবা নাকি কিছুদিন থেকে প্রায়ই বলছেন এই বাড়ির ওপর কোনও কুপিত গ্রহের দৃষ্টি পড়েছে। বাড়িটা বেচে দিয়ে নিউ টাউনশিপ এলাকায় যাওয়া উচিত। কিন্তু শচীনবাবুর বক্তব্য ওই এলাকায় জমির দাম অনেক বেশি। তা ছাড়া, ঠাকুরবাড়ি ফেলে রেখে অন্য জায়গায় গেলে গৃহদেবতা রুষ্ট হবেন।
চণ্ডীবাবু বললেন,–কদিন আগে আমি শচীনের বাবাকে দেখতে গিয়েছিলুম। অহীনকাকা আমার হাত চেপে ধরে বললেন,–চণ্ডী, এই বাড়ি থেকে আমাদের চলে যাওয়া দরকার। তুমি অন্তত একটা ভাড়ার বাড়িও দেখে দাও আমাদের। আজকাল তো কালিকাপুরে অনেক সরকারি অফিস হয়েছে, অনেকে বাড়ি ভাড়া দিচ্ছে শুনেছি।
আমি অহীনকাকুকে বলেছিলুম,–আপনারা তো এখানে ভালোই আছেন। এরকম চারিদিকে মোটামুটি ভোলামেলা বাড়ি কোথাও পাবেন না।
তখন অহীনকাকু চাপাস্বরে আমাকে বললেন,–রোজ রাত্রে বিনোদ পাগলার প্রেত এসে হানা দিচ্ছে। ভয় পাবে বলে শচীন বা আমার ভাই মহীনকে কথাটা বলিনি। চণ্ডীবাবু হাসতে-হাসতে আরও বললেন,–অহীনকাকু নাকি ঘরের ভেতরে তাঁকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছেন। এমনকি তার বোন বাসন্তীও নাকি রাতদুপুরে স্পষ্ট তাকে দেখেছে। মেয়েদের সাহস বেশি, আর বাসন্তীর তত সাহসের সীমা নেই।
ওসি মিস্টার সেন বললেন, হ্যাঁ, ওই পাড়ায় ভূতের গল্প জোর রটে গেছে। তারপর হঠাৎ এই হাড়িকাঠে রক্তপাত। আফটার অল সব গ্রামের মানুষ তো! সন্ধ্যা হতে-না-হতেই দরজা এঁটে বাড়িতে ঢুকে থাকছে। গত একসপ্তাহ ধরে ওই এলাকায় পুলিশ রাউন্ডে গেছে, কিন্তু রাস্তায় কোনও লোকজন দেখতে পায়নি।
কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন,–মিস্টার সেন, তাহলে এবার ওঠা যাক।
ওসি মুখে কৌতুক ফুটিয়ে বললেন, আপনি কি সরেজমিনে তদন্ত করতে চাটুজ্যে বাড়ি যাবেন?
কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,–একবার যেতে ইচ্ছে করছে। কারণ আপনার মুখে যে সূত্রটা পেলুম সেটা গুরুত্বপূর্ণ। রক্তটা মানুষের যে নয়, কোনও জানোনায়ারের, ওটা যখন জানা গিয়েছে। তখন ভূতের উপদ্রব কিংবা মহীনবাবুর অন্তর্ধান রহস্য অন্যদিক থেকে ভেবে দেখার দরকার আছে।
ওসি প্রণবেশ সেন উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,–কর্নেলসাহেব, পুলিশ সুপার আমাকে না বললেও, আমি আপনাকে সবরকমের সাহায্যের জন্য তৈরি থাকব। শুধু একটা অনুরোধ, একবার আপনি জয়ন্তবাবু এবং মিস্টার হালদারকে আমার গৃহিণীর সামনে উপস্থিত করাবেন। সোজা কথায় বলছি চণ্ডীবাবুসহ আপনাদের তিনজনক একবার আমার গৃহিণীর হাতের রান্না খেতে হবে।
কর্নেল বললেন,–অবশ্যই। তবে আগে চাটুজ্যে বাড়ির রহস্যটা ফাস করতে হবে। আপনার সাহায্যও দরকার হবে। তারপর আপনার নেমন্তন্ন খাওয়া যাবে।
প্রণবেশ সেন আমাদের গাড়ির কাছে এগিয়ে এসে বিদায় দিলেন। রাস্তায় পৌঁছে আমি বললুম,ভদ্রলোককে পুলি। বলে একদমই মনে হল না। অত্যন্ত সরল সাদাসিধে মানুষ।
চণ্ডীবাবু গাড়ির গতি কমিয়ে মুখ ঘুরিয়ে বাঁকা হেসে বললেন,–জয়ন্তবাবু, আজ অবধি কালিকাপুরে এই ভদ্রলোকের মতো কোনও অফিসার আসেননি। উনি আসার পর একবছরেই এলাকার দাগি অপরাধীরা কেউ জেলে পচছে আবার কেউ এলাকা ছেড়ে পালিয়েছে। আমি নিজের চোখে দেখেছি এলাকার একজন দাগি অপরাধী কালু মিঞা, সেনসাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে-বলতে একেবারে কাপড়ে-চোপড়ে–
চণ্ডীবাবু মুখ ফিরিয়ে হাসতে থাকলেন। কর্নেল বললেন,–জয়ন্ত এতদিন ধরে আমার সঙ্গে ঘুরে অসংখ্য পুলিশ অফিসার দেখেছে। তবু এখনও ও পুলিশ সম্পর্কে অজ্ঞ।
অনেক অলিগলি ঘুরে আমাদের গাড়ি যেখানে দাঁড়াল, সেখানে কাছাকাছি কোনও বাড়ি নেই। ডানদিকে একটা আমবাগান আর বাঁ-দিকে একটা পুকুর। পুকুরের পশ্চিমপাড়ে একটা পুরোনো মন্দির। গাড়ি থেকে নেমে বললুম,–আমার ধারণা ওটাই সেই চাটুজ্যে বাড়ির গৃহদেবতার মন্দির।
চণ্ডীবাবু এখানে কিন্তু গাড়ি লক করলেন। ততক্ষণে কর্নেল হনহন করে পুকুরের পাড় দিয়ে এগিয়ে চলেছেন। আমি তাকে অনুসরণ করলুম। মন্দিরের সামনে একটা চত্বর। চত্বরে একটা পশুবলি দেওয়ার হাড়িকাঠ পোঁতা আছে।
হাড়িকাঠে অবশ্য সিঁদুর মাখানো আছে, কিন্তু কোথাও আর রক্তের কোনও চিহ্ন নেই। চণ্ডীবাবু এগিয়ে এসে বললেন,–রক্ত কালই পুলিশ এসে ধুয়ে ফেলেছে। কিছুটা নমুনা অবশ্য নেওয়া হয়েছিল।
মন্দিরের কোনও দরজা দেখলুম না। তবে একটা শিবলিঙ্গ দেখতে পেলুম। কর্নেল মন্দিরের পেছন দিকে ঘুরে আমার সামনে এলেন। সেই সময়েই এক প্রৌঢ়া ভদ্রমহিলা পাশের বাড়ির দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসে আমাদের দেখে থমকে দাঁড়ালেন। চণ্ডীবাবু বললেন,–বাসন্তীদি, চিনতে পারছ, এঁরা কে?
ভদ্রমহিলা করজোড়ে নমস্কার করে বললেন,–পেরেছি বইকি! শচীনের মুখে কর্নেলসাহেবের কথা শুনেছি। আপনারা দয়া করে বাড়ির ভেতরে আসুন।