বাজার এলাকা পেরিয়ে বাঁ-দিকের গঙ্গার ধারে এদিকটায় বাঁধের ওপর পিচ রাস্তা করা হয়েছে। সেই রাস্তায় সবরকমের যানবাহন যাতায়াত করছে। আমাদের ডানদিকে অনেকটা জায়গা জুড়ে গঙ্গার ভাঙন রোধ করার জন্য শাল আর শিশু গাছের ঘন জঙ্গল গড়ে তোলা হয়েছে। এদিকটায় ঘরবাড়িগুলো বেশ সাজানো-গোছানো এবং প্রত্যেকটা বাড়ির সামনে একটা করে ফুলবাগিচা। চণ্ডীবাবু বললেন,–এই দিকটায় নিউ টাউনশিপ গড়ে উঠেছে। এলাকার পয়সাওয়ালা লোকেরা এখানে এসে বাড়ি করেছেন।
কিছুটা এগিয়ে গিয়ে একটা চওড়া রাস্তায় পৌঁছলুম। দেখলুম ডান দিকে গঙ্গা পারাপারের ঘাট আর বাঁদিকে সেকাল-একালে মেশানো সব দোতলা পাকা বাড়ি। কর্নেল বললেন,–কালিকাপুরের অনেক উন্নতি হয়েছে, কিন্তু সরকারি অফিসগুলোর অবস্থা দেখছি একইরকম। ওই বাড়িটা সেই ভূমি-রাজস্ব দপ্তরের অফিস না?
চণ্ডীবাবু বললেন,–ওটার পেছনেই থানা। তবে থানার বাড়িটা দোতলা করা হয়েছে এবং অনেক ভোল ফেরানো হয়েছে।
গাড়ি আবার বাঁ-দিকে ঘুরে যেখানে দাঁড়াল, সেখানে সামনা-সামনি একটা গেট। গেটটা খোলাই ছিল। ভেতরে গাড়ি ঢুকিয়ে একপাশে পার্ক করলেন চণ্ডীবাবু। পুলিশের জিপ আর বেতার ভ্যান দেখে বুঝতে পারলুম, এটাই থানা। গাড়ি থেকে নেমে কর্নেল এবং চণ্ডীবাবু এগিয়ে গেলেন। আমি নেমে গিয়ে চণ্ডীবাবুকে বললুম,–গাড়ি লক করে এলেন না?
চণ্ডীবাবু একটু হেসে বললেন, আপনি ঠিকই বলেছেন, লক করে আসা উচিত ছিল। ওসি প্রণবেশবাবু নিজেই বলেন,থানা থেকে চুরির আশঙ্কা বেশি।
একটা ঘরের জানলা দিয়ে দেখলুম, এক ভদ্রলোক সাদা পোশাকে বসে আছেন। চণ্ডীবাবু আমাদের ঘরে ঢুকিয়ে বললেন,–এই দেখুন, আপনার সেই কিংবদন্তিখ্যাত ব্যক্তি।
তখনই বুঝতে পারলুম ইনিই ওসি মিস্টার প্রণবেশ সেন। তিনি কর্নেলের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। সকৌতুকে বললেন, আমি স্বপ্ন দেখছি, না বাস্তব কিছু দেখছি সেটা পরীক্ষা করে নিই।
কর্নেল হাত বাড়িয়ে দিলে তিনি দু-হাতে হাত চেপে ধরে বললেন,সত্যি আমার জীবন ধন্য হল। আপনার কথা এতকাল উঁচুতলার অফিসারদের মুখে শুনে আসছি, আপনাকে যে স্বচক্ষে দর্শনের সৌভাগ্য হবে কল্পনাও করিনি।
কর্নেল সামনের খালি চেয়ারে বসলেন। তার একপাশে চণ্ডীবাবু অন্যপাশে আমি বসলুম। প্রণবেশবাবু আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, আপনি নিশ্চয়ই সেই খ্যাতনামা সাংবাদিক, জয়ন্ত চৌধুরী? এবার আপনাকে ছুঁয়ে দেখি।
অগত্যা আমাকেও উঠে দাঁড়িয়ে তার সঙ্গে করমর্দন করতে হল।
প্রণবেশবাবু বললেন,–দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকায় জয়ন্তবাবুর যা রেপোটার্জ বেরোয়, আমার গিন্নি তা খুঁটিয়ে পড়েন।
এইসব এলোমেলো কথাবার্তার পর ওসি মিস্টার সেনের কোয়ার্টার থেকে একজন কনস্টেবল ট্রেতে কফি আর স্ন্যাকস নিয়ে এল। সে মৃদুস্বরে বলল,–মাইজি সাহেবদের সঙ্গে একবার আলাপ করতে চান।
মিস্টার সেন বললেন,–তোমার মাইজিকে অপেক্ষা করতে বলো। কর্নেলসাহেবরা এসেছেন বিশেষ একটা কাজে।
কনস্টেবল সেলাম ঠুকে চলে গেল।
আমার আর কফি পানের ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু ভদ্রতা রক্ষা করার জন্য কাপটা তুলে নিতেই হল। কারণ এই কফি যিনি তৈরি করে পাঠিয়েছেন, সেই ভদ্রমহিলা আমার লেখার ভক্ত। ওসি মিস্টার সেন কফিতে চুমুক দিয়ে চাপাস্বরে বললেন,–ব্লাড রিপোর্টের সারমর্ম আজ সকালেই
টেলিফোনে পেয়ে গেছি। ফরেনসিক এক্সপার্টদের মতে রক্তটা মানুষের নয়। চণ্ডীবাবু চমকে উঠে বললেন,–মানুষের রক্ত নয়? তাহলে কীসের রক্ত?
ওসি একটু হেসে বললেন,–কোনও মানবেতর প্রাণীর রক্ত। যে কারণেই হোক, কেউ বা কারা চ্যাটার্জিবাবুদের ভয় দেখাতে চেয়েছে। ভূতের উৎপাতে ওঁরা ভয় পাচ্ছেন না দেখেই সম্ভবত একটা সাংঘাতিক ঘটনা সাজিয়েছে।
কর্নেল চুপচাপ শুনছিলেন। চণ্ডীবাবু জিগ্যেস করলেন, কিন্তু আমি ভেবে পাচ্ছি না, মহীন কোথায় গেল? না কি সে সত্যিই সন্ন্যাস নিয়ে চলে গেছে, এবং তার ঘনিষ্ঠ কোনো লোককে সে সেকথা জানিয়ে গেছে, এবং তার সূত্রেই চাটুজ্যেদের কোনও শত্রু এই সুযোগটাকে কাজে লাগাচ্ছে।
ওসি বললেন,–হ্যাঁ। এ-ধরনের অনেক সিদ্ধান্তে অবশ্য আসা যায়, তবে সবার আগে শচীনবাবু কিংবা তার বাবা যদি আমাদের কাছে কোনও কথা না লুকিয়ে খোলাখুলি বলে দেন, তাহলে আমাদের এগোতে সুবিধে হয়।
এতক্ষণে কর্নেল বললেন, আপনারা নিশ্চয়ই হাত-পা গুটিয়ে বসে নেই।
ওসি বললেন,–না কর্নেলসাহেব, আমাদের তদন্তের কাজ যথারীতি চলছে।
এই সময়েই আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল,–আজ ভোরে গঙ্গার ধারে, বেড়াতে গিয়ে আপনারা কাদের ঢিল খেয়েছেন। তার মানে
কর্নেল হাসতে-হাসতে বললেন, আমরা কারুর ঢিল খাব কেন? আমাদের সঙ্গী হালদারমশাইয়ের হাবভাব দেখে কাচ্চা-বাচ্চারা পাগল বলে ঢিল ছুঁড়তেই পারে।
তখনই বুঝতে পারলুম, কথাটা বলা আমার উচিত হয়নি। কর্নেল খুব দরকার না হলে কোনও কেসে নিজের হাতের তাস পুলিশকে দেখাতে চান না।
এদিকে কর্নেলের কথা শুনে চণ্ডীবাবু হেসে উঠেছিলেন। আর ওসি প্রণবেশ সেনও হাসতে-হাসতে বললেন,–হালদারমশাই মানে সেই প্রাইভেট ডিটেকটিভদ্রলোক? যাঁর কথা জয়ন্তবাবুর রেপোর্টাজে পড়েছি। তিনি তো রিটায়ার্ড পুলিশ ইন্সপেক্টর। তো তাকে সঙ্গে আনলেন কেন?