বটে!
কেবিনটা ছোট্ট। দুধারে দুটো শোওয়ার বাঙ্ক। মধ্যিখানে একটা ডাইনিং টেবিল। টেবিলে ম্যাপ বিছিয়ে কর্নেল এবং ডঃ ভাস্কো কোকো দ্বীপের অবস্থান দেখছিলেন। ডঃ ভাস্কো বললেন, দ্বীপের এই ম্যাপটা রাষ্ট্রপুঞ্জের লোকেরা হেলিকপ্টার থেকে দেখে তৈরি করেছিলেন। দ্বীপের গড়ন লক্ষ করুন। প্রায় একফালি চঁাদের মতো। ইংরেজিতে ক্রেসেন্ট বলা চলে। তো পলিনেশীয় অঞ্চলের ভাষায় চন্দ্রকলাকে বলে কোকো। মোটামুটি দৈর্ঘ্য তিন মাইল। মাঝখানে চওড়া অংশ মাত্র এক মাইল। পিঠের দিকটা খাড়া পাথুরে পাহাড়। উলটো দিকটা ঢালু এবং অজস্র খাড়ি আছে। এই জায়গাটুকু বালির বিচ। আমরা বিচ দিয়ে দ্বীপে পৌঁছেছিলাম।
কর্নেল বললেন, মনে হচ্ছে বিচের উত্তর অংশে ঘাস আর ফুলের জঙ্গলে প্যাঁচা-প্রজাপতির ঝাঁক দেখেছিলাম।
ডঃ ভাস্কো বললেন, এখন ওদিকটায় দুর্ভেদ্য জঙ্গল। আমরা ক্যাম্প করেছিলাম বিচের ওপরে এইখানে। কিছুটা জঙ্গল সাফ করতে হয়েছিল।
কর্নেল আইউংকে বললেন, ভাই আইউং! আপনার ট্রলার কতক্ষণে পৌঁছতে পারবে?
আমুদে বুড়ো জেলে কুতকুতে চোখে হেসে বলল, ঘন্টাতিনেক লেগে যাবে। আমরা সাপের লেজ ধরে এগোচ্ছি। মুরিয়া, রাইয়াতিয়া, তারপর বোরাবোরা দ্বীপের পাশ কাটিয়ে সাপ ব্যাটাচ্ছেলে দৌড়চ্ছে কোকোর বুক ঘেঁষে।
ডঃ ভাস্কো একটু হাসলেন। সাপ বলতে ও সমুদ্রস্রোতের কথা বলছে।
আইউং বলল, লেজ ছাড়লেই কিন্তু বিপদ। তবে ভাববেন না। চিচিনের মুঠোর জোর প্রচণ্ড।
কর্নেল বললেন, আপনি কি কখনও কোকোর কাছাকাছি মাছ ধরেছেন?
ওখানে হাঙরগুলো রাক্ষুসে।
কখন হালদারমশাই আমাদের কাছে এসেছেন, লক্ষ করিনি। বলে উঠলেন, হাঙর ভেলা উলটে দেবে না তো?
কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন, দিতেও পারে। তখন সাঁতার দিতে হবে কিন্তু।
গোয়েন্দা ভদ্রলোক সহাস্যে মাতৃভাষায় বলে উঠলেন, রিভলভার পাইছি। গুলি করুম। আর কারে ডর? তবে ভেলা উলটাইলে সাঁতারের কথা কইলেন। কর্নেলসার, আমি জলপোকা।
কর্নেল আইউংকে বললেন, আচ্ছা ভাই আইউং, কোকো দ্বীপের ঘোড়া-মুখো মানুষ সম্পর্কে আপনার কী ধারণা?
আমুদে আইউংয়ের মুখ সঙ্গে-সঙ্গে কেমন যেন পাংশু হয়ে গেল। চাপা স্বরে বলল, আমার ছেলে চিচিন একদিন দূরবিনে একপলকের জন্য ভয়ঙ্কর জন্তুটাকে দেখতে পেয়েছিল। তারপর থেকে আমারা কোকো দ্বীপ এড়িয়ে চলি। তবে এই যে আপনাদের পৌঁছে দিতে কোকো দ্বীপের কাছে যাচ্ছি, সেটা মাননীয় আলবের্তো ভাস্কোমশাইয়ের খাতিরে। ওঁর সাহায্য ছাড়া তাহিতিতে আমি রাজনৈতিক আশ্রয় পেতাম না। আমি ওঁর কাছে ঋণী।
কোকো দ্বীপে আপনি বা চিচিন সন্দেহজনক আর কিছু কখনও লক্ষ করেছেন কি?
আইউং একটু চুপ করে থেকে বলল, দ্বীপটা সত্যিই ভূতুড়ে। কমাস আগে একরাত্রে ওখানে একটা আলো দেখেছিলাম। আলোটা কিছুক্ষণ নড়াচড়া করে নিভে গেল।
ডেকে প্রচণ্ড হাওয়া আর জলের ঝাপটানি। কৃষ্ণপক্ষের চাঁদের আলো ফুটেছে। কিন্তু গাঢ় কুয়াশার সঙ্গে জ্যোৎস্না মিশে সবকিছু অস্পষ্ট। ট্রলারের আলোর ছটায় কালো জলের আলোড়ন দেখা যাচ্ছে। আইউং এঞ্জিনঘরে গিয়ে কম্পাসের ওপর ঝুঁকে ছেলেকে কিছু নির্দেশ দিচ্ছিল।
কিছুক্ষণ পরে ডঃ ভাস্কো ডেকে গেলেন। তিনি রক্ষিদ্বয় কোয়া এবং তিকির সাহায্যে রবারের ভেলা পাম্প করে ফুলিয়ে তাতে জিনিসপত্র বোঝাই করতে ব্যস্ত হলেন। দেখলাম ভেলায় দুটো করে ছোট্ট বৈঠা আটকানো আছে। হালদারমশাই তাঁর বাইনোকুলার নিয়ে ডেকে পা বাড়িয়েই পিছিয়ে এলেন। কর্নেল ডেকের রেলিংয়ে ভর দিয়ে বাইনোকুলারে সমুদ্র দর্শন করতে থাকলেন। হালদারমশাই বাঁকা মুখে বললেন, গা গুলোচ্ছে। কী বিচ্ছিরি গন্ধ! বাথরুম কই?
দেখিয়ে দিতেই গোয়েন্দপ্রবর সবেগে ঢুকে গেলেন। সমুদ্রে ভাসলে সি সিকনেস হয় তাই আমাকে এবং ওঁকে কর্নেল ওষুধ খাইয়েছিলেন। বুঝলাম, হালদারমশাইয়ের ওষুধ খাওয়া ব্যর্থ হয়েছে। ঢেউয়ের নাগরদোলায় এই রোগটার প্রাদুর্ভাব ঘটে। মানুষকে কাহিল করে ছাড়ে। আমারও অবশ্য বমিভাব আসছিল। কিন্তু তার চেয়ে কাবু করেছিল মাথার যন্ত্রণা। বেগতিক দেখে অ্যাসপিরিনের বড়ি গিলব ভাবছি, সেই সময় ডঃ ভাস্কো কেবিনে ঢুকলেন। আমার হাতে অ্যাসপিরিনের বড়ি দেখে হাঁ-হাঁ করে উঠলেন। সাংঘাতিক প্রতিক্রিয়া হবে মিঃ চাউদ্রি। সহ্য করুন। আর আধঘন্টা পরে আমরা ডাঙায় পৌঁছে যাব। দেখবেন, মাথায় আর যন্ত্রণা হচ্ছে না।
হালদারমশাই করুণ মুখে বেরিয়ে এসে বাঙ্কে চিত হলেন। পরক্ষণেই বাঙ্ক থেকে গড়িয়ে পড়ে মাতৃভাষায় কিছু একটা গালমন্দ করে উঠলেন।
ডঃ ভাস্কো তাকে উঠতে সাহায্য করে বললেন, উপকূলের কাছাকাছি বলেই ঢেউটা বেশি। কর্নেলের ডাক ভেসে এল, ডঃ ভাস্কো, ডঃ ভাস্কো, ডঃ ভাস্কো!
ডঃ ভাস্কো কেবিনের দরজা দিয়ে ডেকে ফিরে গেলেন। আমি টলতে-টলতে দরজায় উঁকি দিলাম। সমুদ্রের গর্জন আর এঞ্জিনের শব্দে ওঁদের কথা শোনা যাচ্ছিল না। কিন্তু ওঁদের হাবভাব দেখে মনে হল দুজনেই উত্তেজিত। ততক্ষণে হালদারমশাই আবার বাথরুমে ঢুকেছেন।
কর্নেল এবং ডঃ ভাস্কো কেবিনে ফিরে এলেন একটু পরে। দেখলাম, কর্নেলের দাড়ি ভিজে একাকার। দাড়ি থেকে জল ঝেড়ে তুম্বাে মুখে বললেন, তা হলে যা ভেবেছিলাম, তা-ই ঠিক হল ডঃ ভাস্কো!
ডঃ ভাস্কো উদ্বিগ্নমুখে বললেন, কিন্তু আপনার দেখতে ভুল হয়নি তো?