কিন্তু একজন সাধারণ নাবিক তাহিতির সেরা অভিজাত হোটেল ফারাতিয়ায় উঠেছে এবং আমাদের দিকে লক্ষ্য রেখেছে। ব্যাপারটা গোলমেলে।
কর্নেল হন্তদন্ত হয়ে গেস্টহাউসে ফিরলেন। ড্রয়িংরুমে টেলিফোন ছিল। ডঃ ভাস্কোর সঙ্গে উনি চাপা গলায় কথা বলতে থাকলেন। ব্যাপারটা আমার কাছে অদ্ভুত মনে হয়নি। তাই সেই বেডরুমে ঢুকে পড়লাম। দেখি, গোয়েন্দা ভদ্রলোক চিত হয়ে নাক ডাকাচ্ছেন। বাইনোকুলার খাট থেকে ঝুলছে। ফিতে গলায় আটকানো। জুতোও খোলেননি। সুইচ টিপে আলো জ্বেলে দিয়ে ডাকলাম, হালদারমশাই! হালদারমশাই!
তিনি তড়াক করে উঠে বসলেন সঙ্গে-সঙ্গে। এয়ারপোর্ট আইয়া পড়ল?
নাহ। ঘোড়া-মানুষ।
কই? কই?
ফারাতিয়া হোটেলে।
অ্যাঁ? বলে হালদারমশাই চোখ রগড়ে খি খি করে হেসে উঠলেন। ও! জয়ন্তবাবু! আমি ভাবছিলাম—
কী ভাবছিলেন, তা আর বললেন না। প্রশস্ত এবং সুন্দর করে সাজানো ঘরের সৌন্দর্য মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখতে থাকলেন। এই ঘরে দুটো বিছানা। হালদারমশাই হঠাৎ উঠে দ্বিতীয় বিছানার গদি টিপে দেখে যেটায় শুয়ে ছিলেন, সেটার গদি টিপলেন, তারপর বললেন, মাখন, বাটার, কিন্তু হেভি ক্ষুধা পাইছে।
ড্রয়িংরুমে চলুন।
কর্নেল তখন হুয়াকে আবার কফি আনতে বলছিলেন। হালদারমশাইকে দেখে ওঁর জন্য হালকা খাবার আনতে বললেন। হালদারমশাই হাসলেন। প্যাসিফিক ওশেন এখান থেকে কত দূরে কর্নেলসার?
বাংলোর নিচেই। ওই দরজা খুলে বেরোলে বারান্দা। তারপর লন। লন থেকে নামলে বিচ।
বাল্যকালে ভূগোলে পড়েছিলাম। এবার ছুঁয়ে দেখব।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে। কাল ভোরে বরং দেখতে যাবেন।
এত কাছে-প্যাসিফিক ওশেন! আর তাকে ছোঁব না?
হুয়া কফি আর স্ন্যাক্স আনল। হালদারমশাই গোগ্রাসে খেলেন। তারপর পুবের দরজা খুলে বেরিয়ে গেলেন। বিচ পর্যন্ত অবশ্য উজ্জ্বল আলো পড়েছে ল্যাম্পপোস্ট থেকে। কর্নেল এবং আমি বেরিয়ে ওদিকের বারান্দায় বসলাম। দেখলাম, হালদারমশাই বিচে নেমে থমকে দাঁড়িয়েছেন। রাতের সমুদ্র দেখে ভয় পাওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু হঠাৎ উনি গুঁড়ি মেরে বসলেন এবং বাঁ দিকে হামাগুড়ি দেওয়ার ভঙ্গিতে এগিয়ে অদৃশ্য হলেন।
কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, চলো তো, দেখি কী ব্যাপার!
বিচে নেমে দেখলাম, হালদারমশাই কার সঙ্গে বালির ওপর জড়াজড়ি কিংবা কুস্তি করছেন। আমরা দৌড়ে যেতেই লোকটা বিচের শেষ প্রান্তে পাথরের চাইয়ে উঠে কাঁটাতারের বেড়া গলিয়ে পালিয়ে গেল। হালদারমশাই ফেস-ফেঁস শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন, ঘুঘু দ্যাখছে, ফঁাদ দ্যাখে নাই। চুপিচুপি কাঁটাতারের বেড়া গলিয়ে ব্যাটা যেই নিচে জাম্প করেছে। পড়েছে আমার কোলে। বলে গোয়েন্দাপ্রবর খি খি করে হাসতে লাগলেন।
অদ্ভুত চিঠি এবং হত্যাকাণ্ড
কর্নেল ঘটনাটা হুয়াকে জানাতে নিষেধ করেছিলেন। হালদারমশাইয়ের মতে, লোকটা চোর। সামনে দু-দুটো গার্ড রেখেছে। এদিকে পেছনে চোর আসার রাস্তা পরিষ্কার। চোর কি সামনের দিক দিয়ে আসে? গভর্নমেন্টের কাজ-কারবার সব দেশেই এক।
বুঝলাম, প্রাক্তন দুঁদে দারোগা হাত ফসকে চোর পালানোর জন্য খাপ্পা হয়ে গেছেন। কিন্তু এবার আমার মনে আতঙ্কের ছায়া পড়েছিল। কর্নেল আবার টেলিফোনে ডঃ ভাস্কোর সঙ্গে কথা বললেন। তারপর চুরুট ধরিয়ে র্যাক থেকে একটা প্রকাণ্ড বই টেনে নিয়ে বসলেন। আমি পোশাক বদলে এলাম। দেখাদেখি হালদারমশাইও বদলে এলেন। সময় কাটছিল না। হালদারমশাই ক্রমাগত গোঁফে তা দিচ্ছিলেন এবং দুই কানে আঙুল ঢুকিয়ে গুঁতোগুঁতি করছিলেন। কতক্ষণ পরে ডঃ ভাস্কো এলেন। হুয়া আর-এক প্রস্থ কফি দিয়ে গেল।
ডঃ ভাস্কো বললেন, ফারাতিয়া হোটেলে কোনও ভারতীয় নাগরিক ওঠেননি। আজ প্যান অ্যাম ফ্লাইটে যারা এসেছেন, তাঁদের কারও বাহুতে ঘোড়া-মানুষের উল্কি নেই। আমার ভয় হচ্ছে। কর্নেল সরকার, এই তল্লাশির জন্য পর্যটন দফতর চটে যাবে। পর্যটন থেকেই তাহিতির মোট রাজস্বের ৭৫ শতাংশ আসে।
কর্নেল বললেন, তা হলে লোকটা অন্য কোথাও উঠেছে। সে ফারাতিয়ার পূর্ব লনে ঢুকেছিল আমাদের ওপর নজর রাখতে। তারপর সে খাড়ি বেয়ে নেমে বেড়া গলিয়ে বিচে লাফ দিয়ে পড়েছিল।
ঠিক। সায় দিলেন ডঃ ভাস্কো। সে কোন উদ্দেশ্যে আসছিল কে জানে? বিচের দিকে আমরা গার্ড রাখি না। কারণ বিচটা মাত্র পঞ্চাশ মিটার লম্বা। সারারাত আলো জ্বলে। দুধারে খাড়া পাহাড়। বিচটা প্রাচীন যুগে একটা খাড়িই ছিল। যাই হোক, আরও দুজন গার্ড বিচের দিকে রাখা হচ্ছে। তারা এখনই এসে যাবে। আর একটা কথা, সতর্কতার জন্য আমাদের প্রোগ্রাম বদলেছি। জাঁ ব্লকের জাহাজে যাচ্ছি না। একটা ট্রলার কোকো দ্বীপের ওদিকে মাছ ধরতে যায়। ট্রলারের একটা সুবিধে আছে। দ্বীপের খুব কাছাকাছি পৌঁছতে পারে। কাজেই আমাদের মোটরবোটের দরকার হবে না। দুটো রবারের ভেলাই যথেষ্ট।
হালদারমশাই উদ্বিগ্ন মুখে বললেন, হঠাৎ দরকার হলে আমরা কি ভেলায় চেপে ফিরতে পারব?
কর্নেল বললেন, ভয় নেই হালদারমশাই। ভেলা অকূলে ভেসে যাবে না। হাজার-হাজার দ্বীপের মধ্যে যে-কোনও দ্বীপে পৌঁছে দেবে। অবশ্য সেখানে ঘোড়া-মানুষের চেয়ে সাংঘাতিক প্রাণীও থাকতে পারে।
হালদারমশাই দেশোয়ালি ভাষায় বললেন, না, না। তা কইতাছি না।
ডঃ ভাস্কো বললেন, আমাদের সঙ্গে ব্যাটারিচালিত রেডিয়োট্রান্সমিটার থাকবে। সিগন্যাল রিসিভিং সেট থাকবে ট্রলারের মালিক আইউংয়ের কাছে। সে কাছাকাছি দ্বীপগুলোর মধ্যে ঘুরে বেড়াবে। সিগন্যাল পেলেই হাজির হবে। আইউং চিনা জেলে। তাহিতিতে যৌবনে পালিয়ে এসেছিল। সে আমাদের সরকারের বিশ্বস্ত লোক। মাছ ধরতে গিয়ে অন্য দেশের যুদ্ধজাহাজের গতিবিধির খবর এনে দেয়। এদিকে জাঁ ব্লাক কোম্পানি ফরাসি হলে কী হবে। তাদের নাবিকরা মাতাল হলেই বেফাঁস কথা উগরে দিয়ে নিজের সরকারকেই বেইজ্জত করে।