আমরা একটা ছোট্ট নদী পেরিয়ে গেলাম। ডঃ ভাস্কো গাইডের ভঙ্গিতে বিবরণ দিচ্ছিলেন। নদীটার নাম পাপেনু। ওই নারকোলবাগানের ওধারে গেলে তাহিতির শেষ স্বাধীন রাজা পঞ্চম পোমারির কবর দেখা যাবে। আরও উত্তরে পয়েন্ট ভেনাস। ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ অভিযাত্রী জেমস কুক সূর্যের সামনে দিয়ে শুক্রগ্রহের পরিক্রমা পর্যবেক্ষণের জন্য এসেছিলেন।
কর্নেল আস্তে বললেন, কুক ট্রানজিট অফ ভেনাস দেখতে এসেছিলেন।
ডঃ ভাস্কো আওড়াচ্ছিলেন, জোড়ের পর দ্বিতীয় ভূখণ্ডের নাম তাহিতি ইতি। প্রকৃতিপরিবেশ দফতরের বাংলার কাছে মা-উ-উ গ্রাম। সেখানে একটা ছোট বাংলো আছে। বিখ্যাত ব্রিটিশ লেখক সমারসেট মম সেই বাংলোয় বসে বিখ্যাত ফরাসি চিত্রকর গগ্যাঁকে নিয়ে মুন অ্যান্ড সিক্স পেন্স নামে বই লিখেছিলেন। গগ্যাঁ থাকতেন পুনা-আ-উ-ই- আ বসতি এলাকায় ভিলা ভেতুরা নামে একটা বাড়িতে। তাহিতির একজন মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন। মমের বাংলো এবং গগ্যাঁর বাড়ি কাল মঙ্গলবার আমাদের দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।
হালদারমশাই নড়ে উঠলেন। অ্যাঃ, কাইল মঙ্গলবার হইলে আইজ সোমবার। আমরা দমদমে প্লেনে উঠছি শুক্রবার মর্নিংয়ে। দুইটা দিন গেছে। আইজ রবিবার। সানডে!
কর্নেল হাসলেন। হালদারমশাই! আমরা অন্তর্জাতিক তারিখরেখার পূর্বে চলে এসেছি। ওই রেখার পশ্চিমে যখন রবিবার, তখন পূর্বে সোমবার।
কন কী? একই দিনে দুই তারিখ!
হ্যাঁ। পরে আপনাকে বুঝিয়ে দেব।
হালদারমশাই গুলিগুলি চোখে তাকিয়ে রইলেন। সরকারি বাংলোয় পৌঁছতে মাত্র পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগল। লনে ফুল-বাগিচা, রঙিন টালির ঢালু ছাদ এবং দেওয়ালে আষ্টেপৃষ্ঠে বাহারি লতা-বাংলোটা সত্যিই অতুলনীয়। দুজন সশস্ত্র রক্ষী সেলাম দিল গেটে। তাদের তাহিতির লোক বলে মনে হল। একজন উর্দিপরা দৈত্যাকৃতি লোক এসে আমাদের লাগেজ নিয়ে গেল।
এয়ারকন্ডিশনড বাংলোয় ঢুকে ডঃ ভাস্কো বললেন, ওর নাম হুয়া, একসময় আমেরিকায় ছিল। তাই ইংরেজি জানে। খুব বিশ্বস্ত লোক। এখন স্থানীয় সময় বিকেল তিনটে। আপনারা ঘড়ি মিলিয়ে নিন। সাড়ে চারটেয় সূর্যাস্ত। আমরা পাঁচটায় ডিনার খাই। আপনারা কখন খাবেন বলে দেবেন। হুয়া আপাতত কফি আর হালকা কিছু খাবার আনো!
হুয়া চলে গেল। হালদারমশাই বললেন, বেডরুম কই? হোয়্যার ইজ দি বেডরুম?
ডঃ ভাস্কো ওঁকে বেডরুম দেখিয়ে দিলেন। উনি তখনই ঢুকে গেলেন। বললাম, হালদারমশাইয়ের খিদে পাওয়ার কথা। কিন্তু হঠাৎ বেডরুমে ছুটলেন কেন?
আমরা ড্রয়িংরুমে বসে ছিলাম। চারদিকে র্যাকভর্তি বই এবং সুদৃশ্য টবে রকমারি খুদে উদ্ভিদ। একটু পরে হুয়া কফি এবং খাবার ভর্তি ট্রে আনল। ডঃ ভাস্কো সেই বেডরুমের দরজা খুলে হালদারমশাইকে ডাকতে গেলেন। তারপর ফিরে এসে মুচকি হেসে বললেন, ডিটেকটিভ ভদ্রলোক ঘুমোচ্ছেন।
কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন, ডিটেকটিভ নন। উনি অর্নিথোলজিস্ট।
ডঃ ভাস্কো হাসলেন, ঠিক। ঠিক। ভুলে গিয়েছিলাম। এবার আমাদের প্রোগ্রামের কথা বলি। কাল বিকেলে পাপিতি-ইতির আহি বন্দর থেকে একটা প্রাইভেট কোম্পানির জাহাজ যাবে ফাতু হিভা দ্বীপে। ওরা যাবে খাদ্যসামগ্রী নিয়ে। পাতু হিভা মার্কিন তদারকে আছে। কিন্তু দ্বীপবাসীরা মার্কিন খাদ্য পছন্দ করে না। তা ছাড়া ওরা ডলারে দাম মেটাতে পারে না। তাই পণ্যবিনিময় প্রথা এখনও চালু আছে। খাদ্যের বদলে নারকোলছোবড়া, শুটকি মাছ, এক ধরনের সামুদ্রিক শ্যাওলা দেয়। সেই শ্যাওলা কিন্তু সুস্বাদু। খাবেন নাকি?
খাব।
হুয়াকে বলে দিচ্ছি। তো কাল ওই জাহাজে আমাদের দুটো মোটরবোট থাকবে। আমরা সূর্যাস্তের আগেই কোকো পৌঁছে যাব। এবার তৈরি হয়েই যাচ্ছি। সঙ্গে যথেষ্ট অস্ত্রশস্ত্র থাকবে।
ডঃ ভাস্কো চলে যাওয়ার পর কর্নেল বললেন, হালদারমশাই ঘুমিয়ে নিন। চলো, আমরা বিচ থেকে একবার ঘুরে আসি। এখানে খুব শিগগির সন্ধ্যা হয়ে যায়।
হুয়াকে বলে আমরা বাংলোর পূর্ব গেট দিয়ে বিচে নেমে গেলাম। ওদিকে কোনও রক্ষী নেই। কিন্তু কে বলে প্রশান্ত মহাসাগর প্রশান্ত? গর্জনে কানে তালা ধরে যাচ্ছিল। আর হাওয়া নয়, যেন সাইক্লোন বয়ে যাচ্ছে। সম্ভবত সরকারি সংরক্ষিত এলাকা বলে ছোট্ট বিচ জনশূন্য। কর্নেল বাইনোকুলারে সামুদ্রিক পাখির ঝাঁক দেখছিলেন। তারপর যেন বিশেষ কোনও পাখিকে অনুসরণ করার মতো বাঁ দিকে ঘুরলেন। অদূরে উঁচু টিলা। একটা হোটেল দেখা যাচ্ছিল সেখানে। বাইননাকুলার নামিয়ে কর্নেল বললেন, অদ্ভুত!
চমকে উঠে বললাম, কী অদ্ভুত?
ওই লোকটা!
কোন লোকটা?
দমদমে ওকে দেখেছি। হংকংয়ে দেখেছি। ফা-আ-আ এয়ারপোর্টেও দেখেছি। গোয়র পর্তুগিজ বংশোদ্ভূতদের মতো দেখতে। তো ওই হোটেলটার নাম দেখলাম, ফারাতিয়া। লোকটা বাইনোকুলারে আমাদের দেখছিল।
দেখতেই পারে। আপনি যেমন দেখছিলেন। নিছক কৌতূহল।
লোকটা জাহাজের নাবিক ছিল। কিংবা এখনও নাবিক। কারণ ওর বাহুতে উল্কি দেখেছি। নাবিকদের উল্কি এঁকে নেওয়ার হবি আছে। ওর গায়ে ছিল নেভিব্র স্পোর্টিং গেঞ্জি। হংকং এয়ারপোর্টে ট্রানজিট লাউঞ্জে চোখাচোখি হতেই সে সরে যাচ্ছিল, সেই সময় ওঁর বাঁ বাহুতে উল্কিটা আমার চোখে পড়ে। আলো যথেষ্ট উজ্জ্বল ছিল। এক পলকের দেখা। উল্কিটা ঘোড়া-মানুষের।
মনে-মনে একটু ভড়কে গিয়ে বললাম, খোঁজ নিলে হয়তো দেখবেন লোকটা এই তল্লাটে কোনও জাহাজে চাকরি করে। এখানকার নাবিকদের হয়তো কিংবদন্তিখ্যাত ঘোড়া মানুষের উল্কি এঁকে নেওয়ার হবি আছে।