কর্নেল টাকে হাত বুলিয়ে বললেন, ঘোড়া-মানুষ! হয়গ্রীব বলা চলে। প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রে হয়গ্রীবের কথা আছে। মহাভারতে আছে, বিষ্ণু হয়গ্রীব রূপ ধারণ করে বেদ-চোর দৈত্য মধুকৈটভকে নিধন করেছিলেন। দেবীভাগবত পুরাণ আর শ্রীমদ্ভাগবতে আছে হয়গ্রীব দৈত্যকে বধ করতে বিষ্ণু হয়গ্রীব রূপ ধারণ করেছিলেন। বিষে-বিষে বিষক্ষয়! হালদারমশাই বললেন, শাস্ত্রবাক্য মিথ্যা হয় না জয়ন্তবাবু!
বললাম, ঠিক, কিন্তু হয়গ্রীব বলুন কি ঘোড়া-মানুষ বলুন, তার সঙ্গে দেখছি মার্ডার জড়িয়ে আছে!
তা হলে গুপ্তধনও আছে?
থাকতেই পারে।
কোকো দ্বীপে আলবাত আছে। কোনও পর্তুগিজ জলদস্যুসর্দার মরে ভূত হয়ে তা পাহারা দিচ্ছে। কেউ গেলেই ঘোড়া-মানুষের রূপ ধরে তার ঘাড় মটকে মারছে।
হালদারমশাই খি-খি করে হেসে উঠলেন, কী যে কন!
কর্নেলও এবার অট্টহাসি হাসলেন। তারপর হাঁকলেন, ষষ্ঠী! কফি।
লোকটা কে?
ডঃ ভাস্কো টেলিফোনে কর্নেলকে জানিয়ে গিয়েছিলেন, তার দফতর কর্নেল সরকারের প্রস্তাব বিবেচনা করে দেখবেন। কথাটা শুনে হতাশ হয়েছিলাম। কিন্তু দিন বিশেক পরে মার্চের মাঝামাঝি কলকাতার ফরাসি কনসুলেটের মারফত সরকারি আমন্ত্রণপত্র এসে গেল।
সেই চিঠিতে হালদারমশাইয়ের নামও ছিল। খবর পেয়ে গোয়েন্দপ্রবর কর্নেলের ডেরায় এসে উত্তেজিত ভাবে ঘন-ঘন নস্যি নিচ্ছিলেন। কর্নেল তাকে চমকে দিয়ে বললেন, আমার এবং জয়ন্তের আন্তর্জাতিক পাসপোর্ট আছে। আপনার পাসপোর্ট আছে কি?
পাসপোর্ট? খাইছে! পাসপোর্ট পামু কই?
হালদারমশাই করুণ মুখে তাকালে কর্নেল তাকে আশ্বস্ত করে বললেন, ভাববেন না। ব্যবস্থা করে দেব। কিন্তু মনে রাখবেন, ফর্মে পেশার জায়গায় লিখতে হবে অর্নিথোলজিস্ট। পক্ষিবিজ্ঞানী।
সর্বনাশ! পক্ষীর আমি কী জানি?
দুটো ডানা আছে, এটুকু তো জানেন? ডানা মেলেই পাখি ওড়ে, তা-ও জানেন।
হঃ।
পাখিদের নামও জানেন! কাক, চড়ুই, টিয়া, শালিখ, ময়না, বক, কাদাখোঁচা…
বাহ! তবে এগুলো বাংলা নাম। আপনাকে আমি পাখি বিষয়ে সচিত্র একটা বই দিচ্ছি। মুখস্থ করে নেবেন। এতে দেশ-বিদেশের পাখির ইংরেজি নাম এবং প্রজাতির আন্তর্জাতিক নাম আছে।
হালদারমশাই চিন্তিত মুখে বললেন, ক্রিমিনোলজিস্ট লিখলে চলবে না?
না। আর-এক কাজ করুন। আজই চৌরঙ্গিতে গিয়ে একটা বাইনোকুলার কিনে নিন।
আপনার গলায় যে যন্তরটা ঝোলে?
হ্যাঁ। তবে একটা অসুবিধে হবে। পুলিশমহল আপনাকে প্রাইভেট ডিটেকটিভ হিসেবে চেনে। পাসপোর্টের ব্যাপারে তদন্ত করবে। ভাববেন না। আমি বলে রাখব কর্তৃপক্ষকে। পুলিশকে এ-যাবৎ অনেক সাহায্য করেছি। ওঁরা আশা করি আমার কথা রাখবেন।
কর্নেলের তদ্বিরে হালদারমশাইয়ের পাসপোর্ট খুব শিগগির হয়ে গেল। ফরাসি কনসুলেট থেকে পনেরো দিনের ভিসাও মঞ্জুর হল। আমন্ত্রণপত্রের সঙ্গে তিনজনের প্লেনের টিকিট ছিল। আমরা যাচ্ছি তাহিতির প্রকৃতি পরিবেশ রক্ষার আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবস্থা পরিদর্শনে।
তাহিতি ফ্রান্সের উপনিবেশ। ফরাসি গভর্নরের অধীনে লোকদেখানো স্বায়ত্তশাসন আছে। কর্নেলের কাছে তাহিতির লম্বা-চওড়া যে ইতিহাস শুনলাম, তা আমার মাথায় ঢুকল না। হালদারমশাই পাখির বইটি বিড়বিড় করে মুখস্থ করেছিলেন। ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের প্লেন তখন সপ্তাহে একদিন লন্ডন থেকে দমদম হয়ে হংকং যায়। আমরা সেই প্লেনের যাত্রী। তারপর হংকং থেকে প্যান অ্যামের লস অ্যাঞ্জেলিসগামী প্লেনে তাহিতির রাজধানী পাপিতির ফা-আ-আ এয়ারপোর্টে পৌঁছলাম। ডঃ ভাস্কো গাড়ি নিয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। অভ্যর্থনা জানিয়ে বললেন, সুস্বাগতম।
হালদারমশাই বাইনোকুলারে চোখ রেখে বললেন, খালি ফুল দেখি। পাখি কই?
কর্নেল বললেন, তাহিতিকে স্বর্গদ্বীপ বলা হয়। জানেন তো? এখানকার আদি বাসিন্দারা সবসময় ফুলের সাজ পরে থাকে।
হালদারমশাই হঠাৎ দুই কানে আঙুল খুঁজে পুঁতোগুঁতি করতে করতে বললেন, কান কটকট করে। ব্যথা।
উঁচু আকাশপথে প্লেনযাত্রায় এটা অনেকের হয়।
ডঃ ভাস্কো গাড়ি চালাচ্ছিলেন। তাঁর পাশে কর্নেল। পেছনের সিটে আমি এবং হালদারমশাই। মসৃণ কালো রাস্তা, ঘন ঘাসে ঢাকা ঢেউখেলানো মাটি। নিবিড় ফার্নের জঙ্গল। নির্জন রঙিন বাড়ি। আর শুধু ফুল। যেন ছবির দেশে ঢুকেছি। হালদার-মশাই হঠাৎ আমার হাত খামচে ধরে উত্তেজিত ভাবে বলে উঠলেন, বুগেনভিলিয়া। বুগেনভিলিয়া।
বুঝলাম, এতক্ষণে এখানকার একটা ফুল চিনতে পেরেছেন। কর্নেল মুখ ঘুরিয়ে তাকে। বললেন, জানেন তো? এই ফুলের আদি বাসস্থান এখানে। ১৭৬৮ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি অভিযাত্রী বুগেনভিলে এই দ্বীপে এসেছিলেন। তিনিই এই ফুলের চারা স্বদেশে নিয়ে যান। সেখান থেকে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। তারপর অন্যত্র। তাঁর নামেই ফুলের নাম।
ডঃ ভাস্কো বললেন, ফরাসি উচ্চারণে তাঁর নাম দ বুর্গেভিল।
হালদারমশাই মুগ্ধভাবে বললেন, গাড়িটা যেন ফ্লাইং বার্ড। ননা সাউন্ড। মাখন বাটার!
কর্নেল বললাম, আচ্ছা কর্নেল, বাটারের সঙ্গে কি বাটারফ্লাইয়ের কোনও সম্পর্ক আছে?
কর্নেল বললেন, অবশ্যই আছে। একই গ্রিক শব্দ থেকে…
ডঃ ভাস্কোর কথায় উনি থেমে গেলেন। এয়ারপোর্ট থেকে মাত্র চার মাইল দূরে রাজধানী পাপিতি। তবে আমরা পাপিতিতে ঢুকব না। তাহিতির গড়ন ইংরেজি আটের মতো। দুটো গোলাকার বড়-ছোট ভূখণ্ড জোড়া দিলে যেমন দেখায়। আপনাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। জোড়ের কাছে। সমুদ্রের ধারে আমাদের দফতরের গেস্ট হাউস। আশা করি আপনাদের ভালই লাগবে। ওখানে বিচটা অসাধারণ।