অগত্যা কর্নেলের পরামর্শে আইউং তার দা দিয়ে একটা গাছের ডাল কেটে লাঠি বানাল। সেটা আমাকে দিয়ে আমুদে লোকটি বলল, নাকে ঘা মারলে সব পালোয়ান জব্দ। এ আমাদের চিনা প্রবাদ কর্তা!
কাঁকড়ার রোস্ট, রুটিফল, নারকোলের শাঁস আর কলা দিয়ে সুস্বাদু লাঞ্চ খাওয়ার পর কর্নেল বললেন, আমরা ঝরনার ধার দিয়ে শৈলশিরার দিকে যাব। আমার ধারণা, প্রতিপক্ষ প্রস্রবণের কাছাকাছি কোথাও আছে। কারণ, ওখানেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানিরা ঘাঁটি করেছিল।
ক্যাম্প-লুঠেরারা ভাগ্যিস টর্চগুলো নিয়ে যায়নি। আসলে প্রত্যেকের টর্চ ছিল ক্যাম্পখাটে বিছানার তলায়। ওরা বিছানা খাটসুষ্ঠু উলটে ফেলেছে। টর্চগুলো বিছানার তলায় চাপা পড়েছিল।
নারকোলবনগুলো এড়িয়ে ফার্ন আর ফুলেঢাকা ঝোপের আড়াল দিয়ে আমরা সতর্ক দৃষ্টি রেখে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। একখানে আইউং একটা সাপকে দু টুকরো করল। এবার প্রতিমুহূর্তে সাপের আতঙ্ক। কোথাও কোথাও ঘাসে ঢাকা খোলা জমি আর পাথর। সেখানে আমরা পাথরের আড়ালে খুঁড়ি মেরে এগোচ্ছিলাম। তারপর চড়াই শুরু হল। বাঁ পাশে ঝরনাধারার ছলছল শব্দ। উঁচু গাছের অরণ্যের ঢুকে কর্নেল চাপা স্বরে বললেন, একে বলে রেনফরেস্ট।
প্রতিটি গাছ থেকে ঘন লতাপাতার ঝালর নেমে এসেছে। আইউং দা দিয়ে সাবধানে ঝালরগুলো কেটে পথ করে দিচ্ছিল। আবছা আঁধার। কিন্তু কর্নেল টর্চ জ্বালতে নিষেধ করেছেন। সাপের আতঙ্কে লতা দেখলেই শিউরে উঠছিলাম। একবার আঁতকে উঠে লাঠির ঘা মেরে একটা লতাকে ছেরে দিলাম।
সামনে খোলা পাথুরে জমি দেখা গেল। কর্নেলের ইশারায় আমরা থমকে দাঁড়ালাম। বাঁ দিকে পাথরের একটা প্রকাণ্ড প্রাকৃতিক চৌবাচ্চা দেখা যাচ্ছিল। ওটাই তা হলে প্রস্রবণ। সামনে ন্যাড়া পাথরের পাহাড়ের নিচে কয়েকটা ভাঙাচোরা পাথরের ঘর। কর্নেল বললেন, জাপানিদের ঘাঁটির ধ্বংসাবশেষ। ওই পাঁচিলগুলো বাঙ্কার ছিল সম্ভবত। পাঁচিলে কামান এবং মেশিনগানের নল ঢোকানোর গর্তগুলো এখনও টিকে আছে।
উনি বাইনোকুলারে দেখতে থাকলেন। হালদারমশাইও বাইনোকুলার চোখে রেখে হাঁটু দুমড়ে বসে পড়লেন। একটু পরে একটা বাঙ্কারের আড়াল থেকে একটা লোক বেরিয়ে চারদিক দেখে নিল। তার হাতে রাইফেল। শৈলশিরার ফাক দিয়ে আসা রোদের কাছে আসতেই চিনতে পারলাম তাকে। আমাদের গার্ড কোয়া!
ডঃ ভাস্কো রাইফেল তাক করতেই কর্নেল বাধা দিলেন। ডঃ ভাস্কো চাপা স্বরে বললেন, বিশ্বাসঘাতক কোয়া তিকিকে গোপনে তার সঙ্গে পালাতে বলেছিল। গুপ্তধনের লোভ দেখিয়েছিল।
কর্নেল বললেন, একটু অপেক্ষা করুন।
কোয়া প্রস্রবণের ধারে গিয়ে রাইফেল রেখে আঁজলা ভরে জল খেল। তারপর পায়ের জুতো খুলে পা চুবিয়ে বসে রইল। আইউং ফিসফিস করে বলল, তাহিতির লোকের এই বিচ্ছিরি অভ্যাস! ঘন্টার পর ঘন্টা জলে পা ড়ুবিয়ে বসে থাকবে।
কর্নেলের ইশারায় আমরা ডাইনে ঘুরে জাপানি ঘাঁটির কাছাকাছি চলে গেলাম। মাত্র বিশ মিটার দূরত্ব। বাঙ্কারের পেছনে দুজন লোক শাবল দিয়ে খুঁড়ছে। একজন পাশে দাঁড়িয়ে নির্দেশ দিচ্ছে। ডঃ ভাস্কো শ্বাসপ্রশ্বাসের মধ্যে বলে উঠলেন, এ কী? এ যে দেখছি গিলম্যান।
কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। আপনার সহকারী বিজ্ঞানী পিটার গিলম্যান।
কর্নেল বাধা দেওয়ার আগেই ডঃ ভাস্কো একলাফে বেরিয়ে গর্জন করলেন, নড়লেই খুলি উড়িয়ে দেব গিলম্যান!
পিটার গিলম্যান একলাফে ওপরে একটা ভাঙা ঘরে ঢুকে গেল। ওর সঙ্গী দুজনও ভ্যাবাচাকা খেয়ে ওকে অনুসরণ করল। কর্নেল দৌড়ে গেলেন। ততক্ষণে ডঃ ভাস্কো এবং তিকি সেখানে পৌঁছে গেছে। আইউং এবং আমি দিয়ে দেখি দুটো রাইফেল পড়ে আছে। ভাঙা ঘরের ভেতর কয়েকটা ক্যাম্পখাট এবং আরও কিছু জিনিস। আমাদের ক্যাম্প থেকে লুঠ করে আনা জিনিসপত্রও নিশ্চয় ওর মধ্যে আছে। ডঃ ভাস্কো এবং তিকি ঘরে ঢুকে উধাও হয়ে গেল।
ঘরগুলো শৈলশিরার গায়ে। বারকতক গুলির শব্দ শুনতে পেলাম। কিন্তু হালদারমশাই কোথায় গেলেন? কর্নেল বাঙ্কারের শেষপ্রান্তে গিয়ে বললে, বাঃ, হালদারমশাই, এই তো চাই!
গিয়ে দেখি, হালদারমশাই সবে প্রস্রবণ থেকে উঠছেন। একেবারে বেড়ালভেজা অবস্থা। তবে ওঁর হাতে এখন দুটো রাইফেল। মুখের জল মুছে বললেন, ব্যাটা বানর। পলাইয়া গেল।
বুঝলাম, কোয়ার রাইফেল বাগাতে পারলেও তাকে বাগাতে পারেননি। পুঁড়ি মেরে গিয়ে আগে তার রাইফেল হাতিয়ে ছিলেন। ভাগ্যিস কোয়া এদিকে পেছন ফিরে বসে ছিল। কর্নেল উদ্বিগ্নমুখে বললেন, ডঃ ভাস্কো ওদের তাড়া করে গেছেন। চলো তো দেখি।
বাঙ্কারের রাইফেল দুটোতে গুলি ভরা ছিল। কর্নেল এবং আমি সে-দুটো নিলাম। হালদারমশাই ধপাস করে বসে পড়লেন। আমরা একটার পর একটা ঘর পেরিয়ে গিয়ে দেখি, শৈলশিরার প্রকাণ্ড ফাটলের পাশে একটা চাতালে দাঁড়িয়ে আছেন ডাঃ ভাস্কো এবং তিকি। ডঃ ভাস্কো হতাশ মুখে বললেন, নিচের খাড়িতে ওদের মোটরবোট ছিল। পালিয়ে গেল। এখানে একটা মোটা শেকল ঝুলছে। এটা বেয়ে ওরা উঠে এসেছিল। এটা বেয়েই নেমে গেছে।
কর্নেল বললেন, জাপানি সেনাদের কীর্তি। তবে আশ্চর্য, শেকলটা এখনও ছিঁড়ে যায়নি!
আমরা নিচে সেই বাঙ্কারে ফিরে এলাম। তারপর একটা ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে আঁতকে উঠলাম। হালদারমশাই বাঙ্কারে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছেন। ভিজে রাইফেল দুটো তবু ছাড়েননি। মুখে আতঙ্কের ছাপ। তবু কাকে ধমক দিচ্ছেন, আর আউগ্গাইলেই খুলি উড়াইয়া দিমু! আবার আউগ্গায়? শ্রীবিষ্ণুরে ডাকুম নাকি? দ্বাপরে ব্যাদ চুরি করছিলা। শ্রীবিষ্ণু তোমার ঘাড় মটকাইয়া মারছিলেন। মনে নাই!,