কর্নেল বাংলায় বললেন, ডঃ ভাস্কো আমাদের তিনজনকে তিনটে খেলনা রিভলভার দিয়েছেন হালদারমশাই!
ক্যান?
উনি চাননি আমরা আত্মরক্ষা করতে পারি।
ক্যান? ক্যান?
গুপ্তধনের অভিযাত্রীদের এই স্বভাব। তবে পরে বুঝিয়ে বলব। বলে কর্নেল ডঃ ভাস্কোর হাত ধরে টানলেন। দুঃখ করে লাভ নেই ডঃ গার্সিয়া! এবার পেদ্রোর খুনি এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গদের একটি বিহিত না করে দ্বীপ থেকে চলে যাওয়া উচিত হবে না। সেইসঙ্গে ঘোড়া-মুখো মানুষটাকে পাকড়াও করা দরকার। চলুন। আপাতত ক্যাম্পে ফেরা যাক।
কিন্তু ক্যাম্পে ফিরে হকচকিয়ে গেলাম। দুটো ক্যাম্প মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। জিনিসপত্র চারদিকে ছড়ানো। ভাঙচুর অবস্থা। কোয়া এবং আইউংয়ের কোনও পাত্তা নেই।
হয়গ্রীবের মুখোমুখি
ডঃ ভাস্কোকে এখন কাকতাড়ুয়া দেখাচ্ছিল। ভাঙা গলায় অতিকষ্টে বললেন, আমাদের এখনই দ্বীপ ছেড়ে পালাতে হবে। সাংঘাতিক জন্তুটা কোয়া এবং আইউং বেচারাকে নিশ্চয় মেরে ফেলেছে। এ আমারই পাপের ফল!
তিনি হতাশ মুখে বলল, আমাদের ভেলা দুটো ছিঁড়ে ফেলেছে। আইউংখুড়োর ক্যানোটা ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। আমরা চিচিনের ট্রলারে ফিরব কী করে? হায়! হায়! এবার বেঘোরে প্রাণটা যাবে! শুনেছি, ঘোড়া-মুখো দানোটার গায়ে গুলি বেঁধে না?
কর্নেল বাইনোকুলারে ঝরনার দিকটা দেখছিলেন। বললেন, আচ্ছা হালদারমশাই, হয়গ্রীবকে আপনি কোথায় দেখেছিলেন?
হালদারমশাই উত্তেজনার উপশমে নস্যি নিচ্ছিলেন। বললেন, একটা লোক উঁকি দিচ্ছিল দেখে তাকে ফলো করে যাচ্ছিলাম। ওদিকে পাহাড়ের একটা চাতালে হঠাৎ দেখি হয়গ্রীব। রিভলভারে গুলি বেরোল না। কী করব? পালিয়ে এলাম। আমাকে দেখে বিকট চিঁহি করে দাঁত খিচিয়ে তেড়ে আসছিল।
কর্নেল বললেন, একটা খটকা লাগছে। ক্যাম্প থেকে ওই শৈলশিরার দূরত্ব সিধে অন্তত দু মাইল। কাজেই এই ক্যাম্পে জন্তুটা হামা দিয়ে অতদূর পৌঁছতে হলে তার ডানা থাকা দরকার। হালদারমশাই! জন্তুটা দেখতে কেমন?
ভয়পাওয়া গলায় গোয়েন্দাপ্রবর বললেন, ধড় গোরিলার মতো। মুখ ঘোড়ার মতো। কালো কুচকুচে রং। লোমে ভর্তি।
ডঃ ভাস্কো এবং তিকি ক্যাম্প টেনে সরাচ্ছিলেন। ডঃ ভাস্কো বললেন, সর্বনাশ! রেডিয়ো ট্রান্সমিটারটা আছড়ে ভেঙেছে। খাবারের প্যাকেট বোঝাই পেটি দুটো দেখছি না। এ কী! অস্ত্রের বাক্সটাও নেই। এ কখনও জন্তুটার কাজ নয়।
নাহ। বলে কর্নেল হঠাৎ ঝরনার দিকে এগিয়ে গেলেন। তারপর হাঁক দিলেন, মিঃ আইউং, ভয় নেই। গাছ থেকে নেমে আসুন।
দেখলাম, ঝরনার ধারে একটা ঝাকড়া গাছ থেকে আইউং নেমে এল। আমি এবং হালদারমশাই দৌড়ে গেলাম। আইউং বেজারমুখে বলল, ছ্যা ছ্যা, কোয়া এত ভীতু জানতাম না! হঠাৎ আমাকে ফেলে পালিয়ে গেল। আমি ভাবলুম, ও দানোটাকে দেখেছে। তাই গাছে উঠে প্রাণ বাঁচালাম। তারপর তার চোখ গেল ক্যাম্পের দিকে। দানোটা তা হলে সত্যিই হানা দিয়েছিল ক্যাম্পে। সর্বনাশ! আমার ক্যানোটাকে ব্যাটা আস্ত রাখেনি দেখছি!
কর্নেল বললেন, আপনি ক্যাম্পের দিকে তাকাননি? কোনও শব্দ পাননি?
নাহ্। ভয়ে চোখ বুজে ছিলাম। আর ঝরনার যা বিচ্ছিরি শব্দ! কিছু শোনা যায় না!
কর্নেল ক্যাম্পের কাছে ফিরে এসে বললেন, ডঃ ভাস্কো! ক্যাম্প দুটো খাটাতে হবে। খাদ্যের অভাব হবে না। দ্বীপে নারকোল আর ব্রেডক্রুট আছে। ঝরনার জলে মাছের অভাব হবে না। নারকোল-খেকো কাঁকড়াও আছে। কী বলুন ভাই আইউং?
আইউং দোনামনা করে সায় দিল। কিন্তু ডঃ ভাস্কো রুষ্ট হয়ে বললেন, আপনারা থাকুন। আমরা আর এক মুহূর্ত এখানে থাকছি না। কোয়া নিশ্চয় হিংস্র জন্তুটার পাল্লায় পড়েছে। আবার আমাকে সরকারের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। চলো তিকি, আইউং এসো।
আইউং বেজার মুখে বলল, কিন্তু যাবেন কী করে কর্তা? ওদিকের খাড়িতে চিচিন আমাদের জন্য ট্রলার নিয়ে অপেক্ষা করছে। ট্রলারে পেঁৗছতে হলে সাঁতার কাটতে হবে। জলে নামলেই হাঙর গিলে খাবে যে!
এইসময় তিকি তাহিতি ভাষায় ডঃ ভাস্কোকে কিছু বলল। শুনেই উনি চমকে উঠলেন। আইউংয়ের মুখেও বিস্ময় লক্ষ করলাম। তারপর ফোঁস শব্দে শ্বাস ফেলে ডঃ ভাস্কো বললেন, ঠিক আছে কর্নেল সরকার! আমরা থাকছি।
কর্নেল হাসলেন, কোয়ার বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি দেওয়ার জন্য আপনার থাকা দরকার।
বললাম, তার মানে?
মানে যথাসময়ে বুঝবে ডার্লিং! কর্নেল ক্যাম্পের তেরপলে হাত লাগালেন। এসো তোমরাও হাত লাগাও!
ক্যাম্প দুটো খাটানো হল। তিকি আইউংয়ের সঙ্গে গিয়ে ওর থলে এবং সাঁড়াশি নিয়ে এল। অনেক নারকোল আর কাঁকড়া ছিল থলেয়। খুশি হয়ে দেখলাম, ওরা এককাদি কলাও এনেছে। ঝরনার ধারে একটা কলাবনের খবর পাওয়া গেল। কর্নেল বললেন, পলিনেশিয়ার সব দ্বীপে অজস্র কলাগাছ আছে। আমরা এগুলোকে বলি সিঙ্গাপুরি কলা। আসলে এ-সবই প্রকৃতির দান।
ডঃ ভাস্কো কর্নেলের কাছে ক্ষমা চেয়ে আমাদের রিভলভার তিনটে ফেরত নিলেন। তিনটেই খেলনা মাত্র। ভাবতে বুক কেঁপে উঠল, হয়গ্রীবের কথা আলাদা—কিন্তু পেদ্রোর খুনির দলের হাত থেকে খেলনা অস্ত্র দিয়ে কি আত্মরক্ষাও করা যেত?
এবার ডঃ ভাস্কোর সত্যিকার রিভলভার কর্নেলের পাতলুনের পকেটে ঢুকল। তিকির কোমরে বেল্টে আটকানো হ্যন্ডগ্রেনেড ভর্তি ছোট্ট হ্যাভারস্যাক। সে তার রাইফেলটা আমাকে দিতে এলে হালদারমশাই ছিনিয়ে নিলেন। জয়ন্তবাবুর কাম না। আমি চৌতিরিশ বৎসর পুলিশে চাকরি করছি। মিঃ টিকি, গিভ মি ওয়ান এক্সট্রা বুলেটকেস।