ডঃ ভাস্কো আস্তে বললেন, হ্যাঁ।
ডঃ ভাস্কো, বুঝতে পেরেছি, আপনার মন প্রজাপতিতে নেই। আগেও ছিল না। তবে এবার পেদ্রোর খুনি এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গরা আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
উনি চমকে উঠে কর্নেলের দিকে তাকালেন। কিন্তু কিছু বললেন না।
কর্নেল একটু হাসলেন।পেদ্রো গার্সিয়া একসময়ে ছিল তাহিতির জাঁ ব্লাক জাহাজ কোম্পানির নাবিক। সম্ভবত কারও হুমকিতে চাকরি ছেড়ে কলকাতা পালিয়েছিল। মা-আ-উ-আ ইন থেকে ফিরে গতরাত্রে আমি জাঁ ব্লক কোম্পানিতে ফোন করে এ-কথা জেনেছি। তার আগেই অবশ্য আমার একটু সন্দেহ জেগেছিল। বাংলোয় আপনার লেখা প্রজাপতির বইয়ে আপনার পুরো নাম দেখেছিলাম। ডঃ ভাস্কো বিরক্ত মুখে বললেন, গার্সিয়া একটা সাধারণ নাম। আপনি কী বলছেন বুঝতে পারছি না!
পেদ্রো খুন হওয়ার খবর গতরাত্রে আপনিই যেচে পড়ে আমাকে দিয়েছিলেন। তার মানে, পেদ্রোর দিকে আপনার নজর ছিল। আমি খুব কৌতূহলী চরিত্রের লোক ডঃ গার্সিয়া! এখানে আসার আগে কোকো দ্বীপ সম্পর্কে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে গিয়ে পুরনো সামরিক নথিপত্র ঘেঁটেছিলাম। ১৭৬০ সালে পর্তুগিজ জলদস্যু ওভালদো দে মেলো দে গার্সিয়ার ঘাঁটি ছিল কোকো দ্বীপ। পরে জেনেছি, পেদ্রো গার্সিয়া ছিল তার বংশধর। জাঁ ব্লাক কোম্পানিতে ফোন করে এ-ও জেনেছি আপনারই সুপারিশে পেদ্রোর চাকরি হয়েছিল। কিন্তু সম্ভবত সে কারও হুমকি চাকরি ছেড়ে পালায়।
এক কথা বারবার শুনতে চাইনে। আপনার বক্তব্য কী?
আপনি বাঙ্গালোর সম্মেলন থেকে কলকাতা হয়ে ফেরার সময় পেদ্রোর সঙ্গে রিপন লেনে দেখা করতে গিয়েছিলেন। সতর্কতার দরুন আপনি কাছেই ইলিয়ট রোডে আমার সঙ্গে দেখা করেন। যাই হোক, পেদ্রো আপনার কথায় আবার তাহিতি এসেছিল। তারপর সম্ভবত সে টের পায় আপনি তাকে ফাঁদে ফেলেছেন। কলকাতার পাসপোর্ট অফিসে মিঃ হালদার তাকে আমার কীর্তিকলাপ জানিয়েছিলেন। তাই সে আমার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে। আমার সঙ্গে ফোনে কথা বলতে সাহস পায়নি, তার কারণ অনুমান করা যায়। ফোনে আপনার আড়িপাতার ভয় ছিল পেদ্রোর।
ডঃ ভাস্কো কুঁসে উঠলেন, কিন্তু আমি ওকে খুন করিনি।
কর্নেল চুরুট জ্বেলে বললেন, না হয় আপনি ওকে খুন করেননি। তবে পূর্বপুরুষের গুপ্তধনের ম্যাপ হাতাতে দরকার হলে তা করতেন আপনি। আপনার দুর্ভাগ্য। তার আগেই আপনার প্রতিপক্ষ পেদ্রোকে খতম করে ম্যাপ নিয়ে পালিয়ে এসেছে। পেদ্রোর সঙ্গে আপনার রক্তের সম্পর্ক ছিল ডঃ গার্সিয়া!
প্রমাণ দিতে পারেন?
পারি। নিহত পেদ্রোর পকেট থেকে পকেটমারদের কৌশলে এই চিঠিটা আমি হাতিয়েছিলাম। চিঠিটা পর্তুগিজ ভাষায় লেখা। পর্তুগিজ ভাষা রোমান হরফে লেখা হয়। তবে আপনার দফতরের বাংলোর পরিচারক হুয়া পর্তুগিজ জানে। সে আমাকে সাহায্য করেছে। এটা আপনার লেখা চিঠি। বলে কর্নেল ওঁকে চিঠিটা দিলেন।
ডঃ ভাস্কো চিঠিটা ছিঁড়ে ফেলে বললেন, ঈশ্বরের দোহাই কর্নেল সরকার। আর এসব কথা নয়। আপনি আমাকে সাহায্য করুন। আপনাকে আমি…
কর্নেল তার কথার ওপর বললেন, গুপ্তধনের ভাগ দেবেন তো? গুপ্তধনে আমার মাথাব্যথা নেই ডঃ গার্সিয়া! আমি সাংঘাতিক ঘোড়া-মুখো মানুষ সম্পর্কেই আগ্রহী!
এতক্ষণে বললাম, কর্নেল আপনি হালদারমশাইয়ের কথা ভুলে গেছেন। তিনি হয়তো বিপন্ন।
কর্নেল হাসলেন। না ডার্লিং, বাইনোকুলারে দেখে নিয়েছি হালদারমশাই ওই শৈলশিরার নিচে একটা পাথরের আড়ালে ঘাপটি পেতে বসে আছেন! বলে তিনি ডঃ ভাস্কোর দিকে ঘুরলেন। হিংস্র দানবটির ভয়ে আপনি আর কোকো দ্বীপে আসার আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন। তা ছাড়া এই বিতর্কিত দ্বীপে বরবার আসতে দেওয়ার অনুমতি তাহিতি সরকার দিতে না। কিন্তু আন্তর্জাতিক প্রকৃতি পরিবেশবিজ্ঞানী মহলে সুপরিচিত এই কর্নেল নীলাদ্রি সরকার আপনার আবার কোকো দ্বীপে আসার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। তবে সতর্কতার জন্য আপনি পেদ্রোকে কি আমার ছায়া না মাড়াতে নির্দেশ দিয়েছিলেন?
ডঃ ভাস্কো গলার ভেতর থেকে বললেন, হ্যাঁ।
নিহত পেদ্রোর আঙুলে এবং খাটের নিচে আতসকাচে আমি জীর্ণ প্রাচীন কাগজের আঁশ দেখেছি। ওটাই সম্ভবত গুপ্তধনের ম্যাপ। কিন্তু আপনি শুনলে দুঃখিত হবেন ডঃ গার্সিয়া, কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে সামরিক নথিপত্রে দেখেছি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানিরা কোকো দ্বীপে সামরিক ঘাঁটি গড়ার সময় ডিনামাইটে ওই শৈলশিরার একটা অংশ ধসিয়েছিল। ব্রিটিশ গুপ্তচর সংস্থার সূত্রে খবর পাওয়া যায়, জাপানিরা সেখানে প্রচুর সোনাদানা, হিরে, জহরত আবিষ্কার করে।
ডঃ ভাস্কো প্রায় আর্তনাদ করলেন, হায় ঈশ্বর!
এই সময় তিকি বলে উঠল, কর্নেল সরকারের সঙ্গী ভদ্রলোক পালিয়ে আসছেন।
দেখলাম, প্রাইভেট ডিটেকটিভ ঊর্ধ্বশ্বাসে আমাদের দিকে দৌড়ে আসছেন। আমাদের দেখতে পেয়ে ওঁর গতি বেড়ে গেল। কাছে এসে হাঁসফাঁস করে বলেন, পলাইয়া যান, পলাইয়া যান। হয়গ্রীব ইজ কামিং!
কর্নেল কিছু বলার আগেই উনি পাশ কাটিয়ে গিয়ে পেছনে একটা নারকোল গাছে তরতর করে উঠে গেলেন। আমরা দৌড়ে গেলাম। কর্নেল বললেন, মাথায় নারকোল পড়বে হালদারমশাই! খুলি ফেটে যাবে।
তখনই একটা নারকোল নিচের পাথরে পড়ে ফটাস শব্দে ফেটে গেল। সঙ্গে সঙ্গে গোয়েন্দপ্রবর নেমে এলেন। ডঃ ভাস্কোকে উত্তেজিতভাবে ইংরেজিতে বললেন, এ কী রিভলভার মশাই! দুনম্বরি জিনিস! ট্রিগার টেনে গুলি বেরোল না!