যদি গাছতলায় বসে থাকে। টুকু দরজায় শেকল তুলে দিল।
ঝড় বৃষ্টির মধ্যে গাছতলায় বসে থাকবে। হয় কী করে। তবে বিরজাসুন্দরীর অসাধ্য কর্ম কিছু নেই। ঝড়ে গাছ থেকে আম পড়তেই পারে, ঝড় বৃষ্টিতে ছুটে যেতেও দ্বিধা করবে না। যদি বাগানে ঢুকে বসে থাকে, বৃষ্টিতে ভিজে গেছে ঠিক। ঝুড়িতে আম তুলেও রাখতে পারে। খোঁজাখুঁজির তো শেষ নেই। ঝোপ জঙ্গলে দু একটা থেকে যদি যায়, ভিজে গিয়েও হাতড়াতে পারে। সহজে গাছতলা থেকে আসার পাত্র যে নয় ভেবেই টুকু ডাকল, দুদুমণি তুমি কোথায়। অবেলায় বৃষ্টিতে ভিজে শরীর খারাপ হবে বোঝো।
কোনো সাড়া নেই।
গাছগুলি সব পর পর দাঁড়িয়ে আছে। টুকু মাথায় সামান্য আঁচল টেনে, উঠোন পার হয়ে কাঁঠাল গাছটার নীচে এসে দাঁড়াল। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে, গরমের এই বৃষ্টিতে বসুন্ধরা ঠান্ডা। গাছপাতা থেকে টুপটাপ জল পড়ছে। দু-তিন বিঘে জমি জুড়ে বাঁশঝাড়, ফলের গাছগাছালি, হলুদের জমি সবই ঠান্ডা মেরে গেছে। কিন্তু গাছতলায় দদমণি নেই। ভাঙা ডালপালার ছড়াছড়ি। ঝড়টা জোর হয়েছে ঘুমের মধ্যে টের পায়নি। কিংবা তার মনে হয় সে জেগেই ছিল, সে তো বৃষ্টি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার থেকে সায়া সেমিজ শাড়ি তুলে নিয়ে ঘরে রেখেছে, ঝড় প্রবল হলে সে টের পেত। কিংবা ঝড় শুকনো ডালপালা খসিয়ে উড়ে গেছে, তারপর ঝুপঝাপ বৃষ্টির শুরু। টিনের চালে বৃষ্টির ফোঁটায় মনোরম শব্দ শুনেই হয়তো তার ঘুম ভেঙে গেছে।
গাছতলায় দুদুমণি নেই। বাঁশঝাড়ের দিকেও গেল, বাড়িটার সঙ্গে বিরজাসুন্দরীর এতো ভাব যে কখন কোথায় গিয়ে চুপচাপ বসে থাকবে বলা যায় না। অবলম্বন বলতে, সে আর এই বাড়ির গাছপালা। পাতা থেকে শুকনো ডাল সবই বড় দরকারি—সবই জড় করে রাখা স্বভাব। কোথায় কী জড় করছে কে জানে। পুকুরপাড়ের দিকটায় যদি থাকে। নারকেল গাছগুলি দুদুমণির চিরশত্রু। কচিকাচা ডাবও গাছে রাখা যায় না। কে যে কখন সব চুরি করে নিয়ে যায়। এই গাছগুলি নিয়ে বিরজাসুন্দরী ঝড় ফাঁপড়ে আছে।
না নেই। সব ফেলে, না বলে না করে উধাও।
কী যে করে!
ফের বারান্দায় উঠে দরজায় শেকল খুলে টুকু ভিতরে ঢুকল। তারপর রান্নাঘরে ঢুকে অবাক। বিরজাসুন্দরীর সাদা পাথরের রেকাবিতে ভাত, কালো পাথরের বাটিতে ডাল, ভাজাভুজি যেমনকার তেমনি পড়ে আছে। কিছু মুখে দেয়নি।
টুকুর বুকটা ছাঁত করে উঠল।
না খেয়ে বের হয়ে গেছে!
কোথায় যেতে পারে? তার মাথা গরম হয়ে যাচ্ছিল—ঠিক আবার কোনো ধান্দাবাজের পাল্লায় পড়ে গেছে। ঘটক সেজে সবাই উপকার করতে আসে।
তা ঠাইনদি, পাত্র বড়োই সুপাত্র। আপনার টুকুকে একবার দেখতে চায়। বলেন তো পাত্রের বাবা মাকে আসতে বলি।
তখন বুড়ির যে কী হয়! সাপের পাঁচ পা দেখে। এরা যে টাকা হাতড়াবার তালে থাকে কিছুতেই বিরজাসুন্দরীকে বোঝানো যাবে না। গাড়ি ভাড়ার নাম করে পালান কাকাই কতবার টাকা নিয়ে গেল। ঠিকমতো দুধ জোটে না, কৃপন স্বভাবের বিরজাসুন্দরী ফোকলা দাঁতে হাসিটি জুড়ে দিয়ে বলবে, যার কেউ নেই, তার ভগমান আছে, তোরা আমার ভগমান।
এখন যে আর এক ভগমানের পাল্লায় পড়ে গেছে টুকুর বুঝতে অসুবিধা হয়। না।
গন্ধর্ব কবচ। সকালেই একবার বিড়বিড় করে বকেছে, হাতে গলায় যেখানেই হোক তিথি নক্ষত্র দেখে ধারণ করতে হবে। আজই সেই তিথি নক্ষত্রের সময় যদি উপস্থিত হয়, কে জানে তারই টানে বের হয়ে গেল কি না।
যা খুশি করুক।
কিন্তু টুকু যাই বলুক, তারই হয়েছে জ্বালা। বড়োমামা মাসেহারা পাঠিয়ে খালাস। মাসের এক তারিখও পার হয় না, রাস্তায় গিয়ে বসে থাকবে। পিওন সুবলসখা যদি সাইকেলে যায়। রাস্তায় দেখা হয়ে গেলে বলবে, খোকার টাকা হয়েছে?
রোজ রোজ কে আর জবাব দেয়, জবাব না দিলেই মাথা গরম বিরজাসুন্দরীর। —তোর বাপের টাকা, বাপ ঠাকুরদার চোদ্দোগুষ্টির উদ্ধার। তারপর টুকুকে ভিজা গলায় বলবে, যা না পোস্টঅফিসে, সাইকেলে যেতে কতক্ষণ। দীনুকে বলবি মাসের আট তারিখ, মানি অর্ডারের নাম গন্ধ নেই।
তখনই বিরাম মাঝির বাউন্ডুলে ছেলে শরদিন্দুকে দেখে টুকু অবাক। টুকু বারান্দা থেকে মুখ বার করে দেখল, শরদিন্দুই। সবাই বলে খ্যাপা। সে ভাবে বাউন্ডুলে। লোকে খ্যাপা বললে তার রাগ হয়। লোকের কী দোষ, বাপই বলে বেড়ায়, মাথা খারাপ, ছেড়া ফাটা জামা কাপড় পড়ে বেড়ায়, আমার কীসের অভাব! মাথার দোষ না হলে কেউ এ-ভাবে ঘুরে বেড়াতে পারে। নিখোঁজ ছিল কতদিন। মাঝে মাঝেই নিখোঁজ হয়ে যায়। আগে থানা পুলিশ, ঘুরাঘুরি শেষ ছিল না। এখন সব হয়ে গেছে। দুদুমণি খোঁজ খবর নিতে গেলে এক বাক্যে সারা—পুত্র আমার পর্যটনে বের হয়েছে ঠাইনদি। পর্যটন ফেরে বাড়ি ফিরবে।
এবারে পর্যটন সেরে ফিরে এলে বিয়ে দিয়ে দাও। ঘর বাড়িতে শেকড় না গজালে থাকবে কেন! মন উড়উড়। তোমারও তো এই বয়েসটা ছিল, বোঝো না কষ্টটা কীসের।
সব বুঝি ঠাইনদি। তবে দেবেটা কে। একখানা কলসি সঙ্গে দিলে সুবিধে হয়। পুত্র আমার মূত্রের সমান ঠাইনদি। কিছু আর ভাবি না। যা আছে কপালে হবে।
এ-কথা বলতে নাই। দশটা না পাঁচটা, এক ব্যাটা তোমার। মুখে আগুন দিতেও লাগবে। কবিরাজ দেখাচ্ছিলে না।
ও নিজেই ধন্বন্তরী, বলে কিনা, সব উজাড় হয়ে গেছে, কিছু নেই, ধাপ্পা, লোক ঠকানো ব্যাবসা। আনারসের ডিগ চিবিয়ে খাচ্ছে—সঞ্জিবনী সুধা পান করছে ভাবে। ঘরে ক-দিন মানুষ থাকে—ঘর তার ভালো লাগে না। মা জননী চোখের জল ফেললে এক কথা, জগজ্জননী বৃহৎ ব্যাপার। মহাবিশ্ব নিয়ে তার কারবার ঠাইনদি। লেখাপড়াই ব্যাটার কাল বুঝলেন ঠাইনদি। আপনার বউমারে কত বুঝিয়েছি, দ্যাখো আমি মুদির ব্যাটা, নম নম করে আতপ চাউল ছিটাতে জানলেই হয়, বেশি বিদ্যার দরকার নাই। শুনল না, শহরে পাঠাল দিগগজ করতে, নে এবারে বোঝ–মাথায় কাকের বাসা নিয়ে হাজির। যখন তখন ডিম পাড়ছে আর এদিক ওদিক উড়ে যাচ্ছে। সাধ্য কী আটকায়।