সে রেগে গেলে দুদুমণি আর দুদুমণি থাকে না, বিরজাসুন্দরী হয়ে যায়।
রাগ হয় না! জোরে হাঁটতে পারে না, কানে শোনে না, চোখে দেখে না ভাল, কোথায় গিয়ে মরে পড়ে থাকবে—এই এক দুশ্চিন্তা তার। রাগ জল হতে অবশ্য সময় লাগে না—কেমন অপরাধী বালিকার মতো তখন কথাবার্তা বিরজাসুন্দরীর।
আমার কী দোষ। নগেনের বউ যে খবরটা দিল।
আবার খবর।
তা দিলে কী করব। ওদেরই বা দোষ কী, ওরা তো জানে তোর জন্য আমার মাথা খারাপ। রাতে ঘুম নাই।
টুকু বুঝতে পারে তখন, হয়ে গেল, সেই এক প্যাচাল সাতকাহন করে বলা, কাকে না ধরেছে তার খবর দেওয়া, কেউ তো মাথা পাতছে না, রাগ করলে হয়।
এই খবরের কথা শুনলেই টুকুর মাথা গরম। আবার মরতে গেছিলো তোমাকে কতবার বলেছি, আমার জন্য তোমাকে ভাবতে হবে না। আমার এক পেট চলে যাবে।
তোর এক পেট, তুই মেয়েমানুষ না। সোমত্ত মেয়ের কখনো এক পেট থাকে। টুকু জানে বিরজাসুন্দরীর মুখে এমনিতেই আগল নেই। সোমত্ত মেয়ের এক পেট মানতেই রাজি না। বিয়ে না হলে মেয়েমানুষ হয়ে কাজ কী।
তুই কি পুরুষমানুষ, তোর এক পেট হবে!
পেট কথাটা কানে বড়ো লাগে। এমন কতরকমের কথা হয়—সে পছন্দ করছে না, বিরজাসুন্দরী হন্যে হয়ে ঘুরুক। তার অপমানের দিকটাও বিরজসুন্দরী বোঝে না। সকালেই কথা কাটাকাটি হয়েছে-মালা-তাবিজের কথাও উঠেছে, কবজ ধারণ করলে, পাত্রপক্ষ আর ফিরে যাবে না। কোথায় কার কাছে খবর পেয়েছে, কিংবা পালন কাকার পরামর্শেও বিরজসুন্দরী যে মাথা মুড়িয়ে আসেনি কে বলবে।
গন্ধর্ব কবচ সোজা কথা না! বিরজাসুন্দরী বিড়বিড় করে নিজেই প্যাচাল শুরু করে দিয়েছিল।
টুকুর আর সহ্য হয়নি।
তাগা তাবিজ পরতে হয় তুমি পরবে। আমার পেছনে লাগবে না বলে দিলাম। তাবিজ গলায় ঝুলিয়ে বসে থাক। দেখতে হয় তোমাকে দেখুক।
তোকে কিছু বলেছি। এতো চোপা।
তবে কাকে বলছ?
নধরকে বলছি। একটা কুকুর সেও বোঝে আমার কষ্ট, তুই বুঝবি কী, তোর কি কোনো ভাবনা আছে! খাস আর ঘুমাস।
টুকু বুঝেছিল, দুদুমণিকে বুঝিয়ে লাভ নেই। যা ভাববে শেষ পর্যন্ত তা করবে। স ক্কাল বেলায় কোনো তিক্ততাই সুখের হয় না। বড়োমাসিও বুঝিয়েছে তাকে, মা আমার কী করবে বল। তোকে কার কাছে রেখে যাবে, এই ভাবনাতে ঘুম নেই চোখে। মার এক কথা, আমি চোখ বুজলে টুকুর কী হবে!
টুকু যে বোঝে না এ-সব তো নয়। ঠিকই বোঝে। পছন্দ হলেও দাবিদাওয়া নিয়ে আটকে যায়। তার হয়ে এই খরচের বহর কেউ নিতে রাজি না। পাসটাস করা ছেলের খাঁইও কম না। সরকারি চাকুরের তো মেলা দাম। তার একটা দুটো পাস থাকলেও না হয় কথা ছিল, তার তো কিছুই নেই। মায়ের মুখ মনে পড়ে না, বাবারও সে দোষ দেয় না, একা মানুষ, সংসার সামলাবে কে? বাবা তার নিজের সংসার, স্ত্রী বাচ্চাকাচ্চা নিয়েই জেরবার। বছরে দু-বছরে তাকে দেখতে এক আধবার চলেও আসে। এই আসাও যে কত গোপনে, সে তার বাবার মুখ দেখলেই টের পায়।
বাবা এলে চোরের মতো বসে থাকে বারান্দায়। বাবা কথা কম বলে—তখন দুদুমণির মুখের কামাই নেই। বাবাকে দেখলে আরও খেপে যায়। সোমত্ত মেয়ে আর কালসাপ সমান, তুমি না তার বাপ, রাতে ঘুমাও কী করে বুঝি না। ভাত হজম হয় কী করে বুঝি না।
টুকু তখন ভারি বিড়ম্বনায় পড়ে যায়।
দুদুমণি তুমি থাকবে?
বিরজাসুন্দরী থামবার পাত্র, আগুনে ঘি পড়ে যাবার মতো ছ্যাঁত করে জ্বলে উঠবে।
থামব। চিতায় উঠে থামব। আলগা সোহাগ দেখাতে কে বলে! কীসের টানে আসে! কর্তব্য অকর্তব্য বলে কথা। আমি হলে মুখ দেখাতে পারতাম না। এ কেমন বাপ, দায় আদায় বোঝে না।
সে না পেরে, বাবাকে সান্তনা দেয়, তুমি কিছু বাবা মনে কর না। দদমণির মাথাটা গেছে। এই নাও গামছা, পুকুরে ডুব দিয়ে এস। দুপুরে খেয়ে যাবে।
বাবা বাধ্য ছেলের মতো উঠে যায়। পুকুর থেকে ডুব দিয়েও আসে। মেয়ের টানে যে আসে বোঝাও যায়। খেতে বসলে, সে পাখার হাওয়াও করে। সে তার সুন্দর কারুকাজ করা আসন পেতে দেয়। ঝকঝকে কাঁসার গ্লাসে জল, দুদুমণি চোপা করে ঠিক, তবে জামাই আদরে যে খেতেও দেয় তাও সে বোঝে।
কুমড়োফুলের বড়া করেছি। আর দুটো নাও।
বাবা কুমড়োফুলের বড়া খেতে ভালোবাসে। গন্ধরাজ লেবু খেতে ভালোবাসে। দুদুমণির এতটুকু কার্পণ্য নেই। জামাইটির কথা ভেবে যে তিনি এক দণ্ড আগে তেতে উঠেছিলেন, যা খুশি মুখে আসে বলে গেছেন, খাওয়ার পাত দেখে মনেই হবে না।
একটু আমের আচার দে তোর বাবাকে।
আর একটুকরো মাছ দে।
মুড়িঘন্ট কেমন হয়েছে?
পায়েসটুকু খাও। তাও যে আস, এই আমার অনেক। সম্পর্ক তো চেষ্টা করলেও মুছে ফেলা যায় না। আমি আর ক-দিন, চেষ্টা তো কম করছি না।
বাবা কোনো কথারই জবাব দেবে না। অপরাধ বোধ সে বোঝে। খোঁড়া মেয়েটার দুর্ভাগ্য তাও বোঝে। চুপচাপ খেয়ে উঠে বাবা আবার বারান্দায় জলচৌকিতে গিয়ে বসলে, দুদুমণিই বলবে, টুকু বিছানাটা করে দে। একটু গড়াগড়ি দাও। বেলা পড়লে রওনা দেবে।
ঝড়ের সঙ্গে বৃষ্টি এল, ঝড়ের সঙ্গে বৃষ্টি চলেও গেল।
গাছের নীচে ভাঙা ডালপালা, আমের কুশির ছড়াছড়ি—আম ডাঁসা হতে সময় লাগে, হনুমানের উৎপাতে কিছু রাখাও যায় না। মানুষের উৎপাত তো আছেই। গাছে আম ডাঁসা হতে থাকলেই বিরজাসুন্দরী চঞ্চল হয়ে পড়ে। দিবানিদ্রাও যায় না। হাতে লাঠি নিয়ে ঠুকঠুক করে গাছতলায় গিয়ে বসে।