এই ঘটনার পর পরই বউমাকে ধীরাজবাবু বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। তারপর যা হয়—বর্ষা নামতেই বাড়ি ফাঁকা করে তিনিও চলে গেলেন। শরীর তাঁর সাদা চাদরে ঢেকে দেওয়া হল।
খবর পেয়ে আত্মীয়স্বজন, চাঁপা এবং তার বাবা মা ভাই বোন সবাই এল। সবারই কৌতূহল, সিঁড়ির চাতালের নীচে কী দেখে ভিরমি খেয়েছিল বউমা!
ঠাকুমা চাতালের নীচে কী খুঁজছিল।
কী করে হয়! মাকে ধরে না নিয়ে গেলে কখনো যেতে পারেন না।
আমি যে দেখলাম বাবা।
ধীরাজবাবু বললেন, ওখানে আছে তো কটা ভাঙা ট্রাঙ্ক। মা ফেলে আসতে চাননি দেশের বাড়ি থেকে। সঙ্গে নিয়ে এসেছেন।
সিঁড়ির চাতালের নীচটা পরিষ্কার করতে গিয়ে চাঁপা সুন্দর কারুকাজ করা একটা কাঠের বাক্স পেয়ে গেল একদিন। সে গোপনে ঘরে নিয়ে বাক্সটা খুলল। কিছুই নেই। সাদা ন্যাকড়ায় জড়ানো একটা খাম। খুব যত্নের সঙ্গে রাখা। খামে আশ্চর্য সুন্দর এক টুকটুকে নতুন বউয়ের ফোটো।
সে ছুটে গেল বারান্দায়।
ধীরাজবাবু চা খাচ্ছিলেন।
কী ব্যাপার! হাঁপাচ্ছ কেন!
দেখুন দেখুন। কী সুন্দর না দেখতে নতুন বউটি! ছবিটি দেখে ধীরাজবাবু বললেন, আমার মার ফোটো। যেই বাড়িতে আসত, বলত, হ্যাঁ অন্নপূর্ণাই বটে। কী সুন্দর চোখ মুখ। ছবিটা মা কিছুতেই হাতছাড়া করত না। কোথায় পেলে! আমরা কিছু বললে, বলতেন, কোথায় রেখেছি মনে করতে পারছি না। মা বোধহয় সেদিন সিঁড়ির চাতালের নীচে ছবিটা খুঁজতে গেছিলেন। নিজের ছবির সঙ্গে মানুষের শেষ ছবির তফাত কত খুঁজে দেখছিলেন বোধহয়।
অবলম্বন
ঝুপঝুপ করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল।
টুকু ধরফর করে উঠে বসল তক্তপোষে। কখন মেঘ করেছে আকাশে টের পায়নি। দাবদাহ চলছে। চৈত্র গেল, বৈশাখের মাঝামাঝি, এক ফোঁটা বৃষ্টি নেই। গরমে দিনরাত হাসফাঁস, লু বইছে। দরজা জানালা খোলা রাখার উপায় নেই। গরম বাতাসে গারে জ্বলুনি, প্যাঁচপেচে ঘাম। আর এ-সময় ঝুপঝুপ করে বৃষ্টি পড়ছে ভাবা যায় না।
টুকু দৌড়ে তক্তপোষ থেকে বারান্দায়, তারপর উঠোনে। তারে মেলা সায়া শাড়ি, বিছানার চাদর, বালিশের ওয়াড় টেনে আবার ঘরে। হাওয়া দিচ্ছে। ঠান্ডা হাওয়া। টুকুর শরীর জুড়িয়ে যাচ্ছে ঠান্ডা হাওয়ায়।
তাপরই মনে হল, দুদুমণি কোথায়। ঘর খালি। কুকুরটা বারান্দায় শুয়ে আছে। বৃষ্টি পড়ছে বলেই হয়তো লেজ নাড়তে নাড়তে উঠোনে নেমে গেল। দুদুমণি বাড়ি থাকলে, কুকুরটা বাড়ি ছেড়ে কোথাও যায় না। সে থাকলেও। কেউ একজন না থাকলে বাড়িতে কুকুরটাও থাকে না। কুকুরটাও বাড়িতে! দুদুমণি গেল কোথায়।
সে গেলে কুকুরটা পেছনে ল্যাকপ্যাক করে হাঁটে।
দুদুমণি গেলে কুকুরটা পেছনে ল্যাকপ্যাক করে হাঁটে।
সেই কুকুর বাড়িতেই আছে। কুকুরটাই তাদের এখন পাহারাদার। দুদুমণি একা রোদে কোথায় বের হয়ে গেল।
আমগাছতলায় থাকতে পারে। ঝড় উঠবে আশঙ্কায় যদি বুড়ি গাছতলায় ছুটে যায়। আম, জাম, জামরুলের গাছ বাড়িটার চার পাশে। কাঁঠাল গাছও আছে। লেবু সফেদা গাছ, যে দিনের যে ফল দাদু নিজ হাতে লাগিয়ে গেছেন। একটা আম চুরি গেলে দুদুমণির চোপার শেষ থাকে না।
টুকু রেগে গেলে, বুড়ি মরতে গেছে ভাবে। ঝড়ে আম পড়বেই। লোকজন সব তাঁদের তাও তার জানা। ঝোপজঙ্গলে লুকিয়ে থাকারও স্বভাব আছে পাড়ার বাচ্চাকাচ্চাদের। দুপুরে বিকেলে কোথা থেকে যে পঙ্গপালের মতো তারা উড়ে আসে বোঝা দায়। দুদুমণি লাঠি হাতে তাড়া করবে। পারে। একদিকে তাড়া করলে অন্যদিকের বোপ থেকে উঠে আসে তারা। না পারলে চেঁচামেচি, ওরে টুকু সব সাফ করে দিল। না পারলে, ওরে নধর সব শেষ করে দিল। কে বেশি বিশ্বাসী তখন বোঝা ভার। সে না নধর। আর নধরও হয়েছে তেমনি, কোথা থেকে লাফিয়ে বের হয়ে আসবে। ছুটে যাবে, ঘেউ ঘেউ করবে। মুহূর্তে গাছপালা সাফ।
আজ তেমন কিছু হলে নধর নিশ্চিন্তে বারান্দায় শুয়ে থাকতে পারত না। দুদুমণি গাছতলায় থাকলে সেও গাছতলায়। ঝুপঝুপ বৃষ্টিতে মুহূর্তে ঘর বাড়ি ঠান্ডা হয়ে গেল। আকাশে মেঘের ওড়াউড়ি। ঝড়ও উঠে গেল। অথচ দুদুমণির কোনো সাড়া পাওয়া গেল না।
সে দরজা পার হয়ে উত্তরের বারান্দায় গেল। না দুদুমণি নেই।
বারান্দায় ছোট্ট চালাঘর, টালির ছাউনি, মাটির মেঝে, উনুনে কাঠপাতায়, রান্না, দুদুমণির খাওয়া খুব তাড়িয়ে তাড়িয়ে—একবেলা আহার, সহজে পাত থেকে উঠতে চায় না। যদি খেতে খেতে ঘুমিয়ে পড়ে, রাগ হলে টুকুর এমনই সব মনে হয়।
সে বারান্দা থেকে অগত্যা নেমে গেল।
বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টিতে ভিজতেও আরাম লাগছে। কিন্তু দুদুমণি গেল কোথায়। তাকে না বলে কোথাও যায় না। অবশ্য যায় না বললে ভুল হবে, এই নগেনের বাড়ি থেকে আসছি বলে, কোথায় কার বাড়ি গিয়ে বসে থাকবে বলা মুশকিল। এক বাড়ি থেকে আরও দশ বাড়ি ঘুরে বেশ বেলা করেই হয়তো ফিরে এল। তারপর দশরকমের কৈফিয়ত দিয়ে এক গ্লাস জল ঢকঢক করে খাওয়া।
খেতে খেতে গ্লাস নামিয়ে বলা, আমি তো বসে থাকি না দিদি, কাকে দিয়ে কী উদ্ধার হয়, তাই সমরেশের বাড়ি হয়ে এলাম…
টুকু বিরক্ত হলে না বলে পারে না, দয়া করে থামবে বিরজাসুন্দরী। বকর বকর ভালো লাগছে না। কখন রাঁধবে, কখন খাবে। আমি রাঁধলে মুখে রোচে না।
হয়ে যাবে। তুই চান করে দু-বালতি জল তুলে রাখ। পুকুর থেকে ডুব দিয়ে এলাম বলে।