তোমাকে ডাকলাম, সাড়া পেলাম না। কোথায় ছিলে।
মা, আমি শুনতে পাইনি। ঘরেই ছিলাম।
আতঙ্ক আবার সেই অন্ধকারে মৃতপ্রায় এক রমণীর কাছে তাকে গিয়ে না দাঁড়াতে হয়। মা বললেন, ভয় কীসের। যা কিছু দেখছ সবই তাঁর দয়ায়। তিনি ছিলেন বলে এই সংসার। তোমার বাবারা চার ভাই দু-বোন। কেউ ফেলনা নয়। তিনি তো গাছের মতো আছেন। কত সকালে ফুল ফুটেছে, ফল হয়েছে তারপর হাওয়ায় বীজ উড়ে গেছে কখন, তিনি নিজেও জানেন না। বীজ এখন গাছ হয়ে গেছে। নতুন গাছে নতুন ফুল। ফল। সব কিছু। তাঁকে ভয় পাবার কি আছে। তিনি তো ন্যাড়া গাছ।
শাশুড়িমা ঠিক ধরে ফেলেছেন। সে ঘরটায় যেতে অস্বস্তি বোধ করছে।
বরং নিজের মতো বউমা কাজ খুঁজে নেয়। ঘরে ঢুকে টেবিল চেয়ার, ঝাড়ন দিয়ে পরিষ্কার করে। গ্রিলের ময়লা ন্যাকড়ায় মুছে দেয়। এক দণ্ড যেন তার বসে থাকার উপায় নেই। আসলে তিনি কখন কী বেশে থাকবেন তাও বলা যায় না। সর্বাঙ্গ খালি। কেবল কোমরের নীচে কোনোরকমে কাপড়টুকু গুঁজে রাখেন। গায়ে কিছু রাখতে পারেন না। বুক শুকিয়ে স্তন দুটি জরুলের মতো হয়ে গেছে। চামড়া কুঁচকে অসাড় হয়ে গেছে। মানুষকে তো আর মেরে ফেলা যায় না যতদিন আছে। সেবা শুশ্রুষা করে যেতেই হবে।
চাঁপা সারাক্ষণ এ-ঘর ও-ঘর করে। শুধু ওই ঘরটায় দিকে তাকাতে পারে না। খেতে বসলেও অস্বস্তি। কখন না বের হয়ে এসে পাশে দাঁড়ান-মাথায় হাত রেখে নাতবউকে আদর করেন। পারতপক্ষে সে একা খেতে বসে না। খাওয়া তো নয় গেলা। তারপর নিজের ঘরে সারা দুপুর দরজা বন্ধ করে থাকা। রূপকের মোটরবাইকের শব্দ পেলেই সে উঠে বসে। জানালা খুলে মুচকি হাসে। ধড়ে তার প্রাণসঞ্চার হয়।
ওই ঘরটা এড়িয়ে চলার বিষয় ধীরে ধীরে সবার নজরে পড়ে গেছে। চাঁপা অপরাধী মুখে সবার সঙ্গে কথা বলে। শ্বশুরমশাই ঘরে তখন শাসাচ্ছেন, কাপড় খুলে ফেলছ কেন? চল বারান্দায় বসবে।
শরীরে কী আর কাপড়ের দরকার আছে বাবা। কাপড় যে রাখতে পারি না। এখন থাক সময় হলে না হয় কাপড় দিয়ে সারা শরীর ঢেকে দিস।
বাবা বোধহয় জোর করে শায়া পরিয়ে দিচ্ছে।
বুড়ির চিলচিৎকার, আরে অধম্মের বেটা, আমাকে তুই মেরে ফেলতে চাস। শরীরে কিছু না থাকলে কী হয়!
চাঁপা জানে বাবা নিজেই বুড়ির কাপড় শায়াতে গুঁজে, সারা শরীর কাপড়ে ঢেকে, ধরে ধরে বারান্দায় এনে বসিয়ে রাখবেন। যতক্ষণ পারা যায়, ঝিম মেরে বসে থাকেন আর বিড়বিড় করে বকেন। শাপশাপান্ত করেন কি না সে জানে না। কারণ বুড়ি যেদিকটায়, সে তার বিপরীত দিকে। চোখে পড়ে যাবে ভেবে সে এখন সোজা তাকিয়ে হাঁটে না।
দেখলে বমি উঠে আসে। মানুষ তো না কঙ্কাল। রাতের বেলা ঘরে একলা ঢুকতেও ভয়। রূপক কিছুক্ষণ তার ঠাম্মার ঘরে বসে মজা করে। অন্য দুই দেওর মন্টু ও রন্টুও ঠাম্মাকে নিয়ে রঙ্গেরসে মেতে যায়। তার তখন রাগ হয়। ঘেন্নাপিত্তি নেই।
রূপক ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে জড়িয়ে ধরতে গেলেই এক কথা—না। আমার কিছু ভালো লাগছে না। হাত পা ভালো করে ধুয়ে এসো। তারপর চোখের জলে ভাসায়। বাপের বাড়ি দিয়ে আসতে বলে। এত আতঙ্ক আর অস্বস্তি নিয়ে সে এই সংসারে আর লেপটে থাকতে রাজি না। বুড়ির শেষ খবর পেলে সে আবার ফিরে আসবে। তবে মুখে কিছু বলে না। মাঝে মাঝে বাপের বাড়ি যাবার জন্য বায়না ধরে ঠিক, কিন্তু সবাই বুঝিয়ে বললে, নিজেকে কেন জানি বোকা লাগে। রূপককে ছেড়ে থাকতেও তার এখন কষ্ট। কী যে করে।
সারাদিন আজ সে ওদিকে মাড়ায়নি। সে আজ বেশ খুশি। জানালায় তার মুখ যে যায় সেই বলে ধীরাজবাবুর পুত্রবধূ লক্ষ্মী প্রতিমা। কী সুন্দর। চোখ আছে ভদ্রলোকের। সে তখন আয়নায়, সে তখন বাথরুমে, নিজেকে দেখতে দেখতে কেমন অভিভূত হয়ে পড়ে। পুষ্ট স্তন, উরুমূলে বিজলি বাতির প্রভা, কালো মেঘের মতো চুলের ঢেউ, আর শরীরে আশ্চর্য সুষমা। বড়ো হতে হতে টের পেয়েছে, শরীরে একটা ফোসকা পড়লেও কষ্ট।
দামি লোশন, এবং বাজারের সব বিজ্ঞাপনের ছবির মতো তার বাড়িটায় উড়ে বেড়াতে ভালো লাগে। কেবল ওই ঘরটার দিকে চোখ গেলেই হিম হয়ে যায় শরীর।
সাঁঝবেলার আগেই ছাদ থেকে সে সবার জামা প্যান্ট শাড়ি শায়া নামিয়ে আনে। রবিবার বলে রূপক বিছানায় আটকে রেখেছিল, সারা দুপুর বিকেল সে শরীরের সর্বস্ব দিয়ে রূপকের সঙ্গে মেতেছিল—তারপর বাথরুম এবং আয়না, পাতায় আইল্যাশ, চোখের নীচে নীলাভ রঙের পালকের স্পর্শ সেরে যখন বের হয়ে এল একেবারে অপ্সরা।
ও বউমা ছাদ থেকে জামাকাপড় নামিয়েছ? এ-কাজটা এখন সে বাড়ির করে থাকে। জিভ কেটে দৌড়ে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে গেল। আশ্চর্য আকাশ মাথার ওপর, নীল নক্ষত্র আকাশে ভাসমান, বসন্তের শীতল হাওয়া—তার ছাদ থেকে নেমে আসতে ইচ্ছে হচ্ছে না। আর তখনই মনে হল, এই বাড়ির এক কোণে জ্যান্ত এক নরকঙ্কালের বাস। সঙ্গে সঙ্গে ভয়। ছুটে তার থেকে সব টেনে পড়িমরি করে নেমে আসতেই সে দেখল চাতালের অন্ধকারে কিছু নড়াচড়া করছে। সে কাছে যেতে সাহস পাচ্ছে না। তব নামতে হবে। সিঁড়ির পাশে কেউ-কে সে। অন্ধকারে দেখল, বুড়ি খুট খুট করে ট্রাঙ্কের ভিতর চাতালের নীচে কী খুঁজছে।
শরীর তার হিম হয়ে গেল। বেহুশ। কোনোরকমে দেয়াল ধরে বসে পড়ল। তারপর গোঙানি।