এই বাড়িতে তাকে থাকতে হবে। তিনি যদি ঘরের বার না হতে পারেন অস্বস্তি কম হবে। যদি বের হতে পারে, সারাদিন প্রায় যেন, তবে চামড়া দিয়ে ঢাকা একটা কঙ্কাল তার সঙ্গে ছায়ার মতো ঘুরে বেড়াবে। কেমন আতঙ্ক ধীরে ধীরে তাকে গ্রাস করছিল।
রাতে রূপক বুকে টেনে নিলে বলল, তোমার ঠাকুমার কী অসুখ?
অসুখ হবে কেন। বয়সের ভার।
চলাফেরা করতে পারেন?
পারেন। তবে বিছানা থেকে একা নামতে পারেন না। ধরতে হয়। দেয়াল ধরে হাঁটেন। বিছানায় পড়ে থাকলে বেডসোর হতে পারে। বাবাকে যমের মতো ভয় পান। সকালে বাবা ধরে নিয়ে যান, বারান্দার ইজিচেয়ারে বসিয়ে দেন। যেখানে বসিয়ে দেবেন, আর নড়বেন না।
চাঁপা বলল, জান আমার না ভয় করে।
কীসের ভয়।
কী ভয় বুঝতে পারছি না।
সে বলতে পারছে না, বাথরুম কিংবা কোনো কাজে একা পড়ে গেলে, তিনি যদি হেঁটে এসে সামনে দাঁড়ান, তার সাহস নেই সামনে দাঁড়িয়ে থাকার।
বাড়িটাতে অবশ্য লোকজন কম না। শ্বশুর শাশুড়ি ননদ জা এবং তাদের ছেলেমেয়ে, দুই মেয়ের জামাই, বাড়িটায় অনেকগুলি ঘর, ঘরের মতোই মানুষজনেরা গিজগিজ করছে। ছোটো দুই দেওর ঠাকুমাকে টেনে তুলে দাঁড় করিয়েছে। বুড়ি রসিকতায় বেশ তুখোড়, কি লা কোমরে জোর আছে তো। দেখিস মিনসের চাপে তুবড়ে যাস না।
অশ্লীল কথাবার্তা। সে তো একমাত্র মেয়ে, বাবা রেলে কাজ করেন। কত দেশ তারা দেখেছে, ঘুরেছে। মা বাবা আর সে। স্কুলের বাসে ফিরেছে। কোয়ার্টারের লনে ব্যাডমিন্টন খেলেছে। সাদা ফ্রক গায়, পায়ে কেডস। তারপর তার নিজের টেবিল, জটায়ুদা এক গ্লাস দুধ নিয়ে হাজির—দুধ দেখলেই তার মাথা গরম, কত সাধ্যসাধনা, এবং সে কখনো কোনো বুড়ো মানুষ বাড়ির আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে দেখেনি। এমন অস্থিচর্মসার তো নয়ই। তার দাদুমণি ঠাকুমা, দিদিমা দাদু বেড়াতে এসেছেন, কিন্তু কী সবল আর হাসিখুশি! মানুষের মুখ তোবড়ানো টিনের মতো হয়, আর দেখলে ভিতরটা এত ঠাণ্ডা মেরে যায় রূপকের ঠাকুমাকে না দেখলে বিশ্বাসও করতে পারত না। কী বিকট চোখ মুখ। ঠোঁট দুটো সাদা। ঠোঁটের কশে ঘা। দাদমণি মারা গেলে বাবা একা গেলেন। ঠাকুমার এখন-তখন, বাবা সবাইকে নিয়ে দেশের বাড়িতে গেলেন। সেও কাটোয়া ইস্টিশনে নেমে ছোটো লাইনে, তারপর কিছুটা গোরুর গাড়ি এবং হাঁটা পথে। সে যে খুব বিরক্ত বাবা ফিরে এসে ভালোই টের পেয়েছিলেন। তবে বাবার জ্ঞাতিগুষ্টির কেউ বুঝতে পারেনি, গাঁয়ের বাড়িতে চাঁপার দম বন্ধ হয়ে আসছে। ময়লা, নোংরা জামাকাপড়, হাঁটুর ওপর ধুতি, গালে দু-পাঁচদিনের বাসি দাড়ি, দরকচা মারা সব মানুষজন, আলাদা বাথরুম নেই, আলো নেই, পাখা নেই—সে হাঁপিয়ে উঠেছিল।
এই বাড়িটায় সব আছে। একতলা বাড়ি, বিশাল ডাইনিং স্পেস। ছেলেদের আলাদা ঘর। শেষদিকের দুটো ঘরে রূপকের বাবা মা থাকেন। সে রূপকের বাবাকে এখনও বাবা বলে ডাকতে পারছে না। তবে রূপকের মাকে মা ডাকতে সংকোচ হচ্ছে না তার। সে সারাদিনই মা মা করছে। বাড়িটার সব এত সুন্দর, কেবল বিকট ভূতুড়ে বুড়িটা বাড়িটাকে হত কুৎসিত করে রেখেছে। একদম বেমানান।
বউভাত হয়ে যাবার পর বাড়ি খালি হয়ে গেল।
চাঁপা এখনও কাজে হাত দেয়নি। মা বলছেন, তোমরাই তো করবে। আমার তো বয়স হয়ে গেল। আর পেরেও উঠি না। কাজের লোকের হাতে রান্না কেউ খেতে চায় না। তৃপ্তি পায় না। নিজের মানুষদের জন্য রান্নাবান্নায় আনন্দ আছে চাঁপা। আনন্দটা খুঁজে নিতে হয়। যতদিন পারব, করব। তারপর তোমরা ছাড়া কে করবে।
চাঁপা দরজার পাশে হেলান দিয়ে সব শোনে।
নাও। তোমার ঠাকুমার ঘরে চা দিয়ে এস। ব্যস শরীরে জ্বর এসে যায়। বুড়ি কীভাবে পড়ে আছে কে জানে। ঘরটায় ঢুকতেই তার ভয় হয়। সারা গা চুলকায়। মরামাস ওঠে। হাঁটুতে দগদগে ঘা। মলম লাগানো বলে ঘা আরও কুৎসিত দেখায়। ঘরে ঢুকলে পচা গন্ধও পায়। পা দুটো অস্বাভাবিক ফোলা। যেন টিপে দিলে পুঁজরক্ত বের হয়ে আসবে। মাথার চুল কাগে বগে ঠুকরে নিয়েছে।
মা, ঠাকুমা সকালে চা খায় বুঝি?
খায় পেলে। বুড়ো মানুষ, মাথাও ঠিক নেই। সবাই খেলে তাঁকে দিতে হয়। খান না-খান দেখি না। খুশি থাকলে খাবেন, অখুশি থাকলে কিছুতেই খাওয়ানো যাবে না। তোমাকে দেখে খুব আহ্লাদ হয়েছে। গুনগুন করে গান গাইছিলেন। তোমার বাবাকে ডেকে বললেন, নতুন বউকে আমার পাশে বসে থাকতে বলো।
মা।
কী!
আমার বাথরুম পেয়েছে।
ঠিক আছে যাও। আমি দিয়ে আসছি।
বউমা তুমি! নাতবউ কোথায়।
ও বাথরুমে গেছে।
আমার নাতবউ কী সুন্দর! ঘর আলো করে রেখেছে। ও কাছে থাকলে বড়ো আনন্দ হয়।
চাঁপা বাথরুমে ঢুকে অক অক করে বমি করল। কেন ওক উঠে এল বুঝতে পারছে না। তারপর মুখ মুছে আয়নায় মুখ দেখল। বড়ো সিঁদুরের ফোঁটা কপালে, সিঁথিতে সিঁদুর রক্তবর্ণ ধারণ করে আছে। সে যে সত্যি ঘর আলো করে আছে আয়নায় নিজেকে দেখলে আরও বেশি টের পায়। ভুরু প্লাক করা। চোখে আইল্যাশ। সকালে ঘর থেকে বের হবার সময়, একেবারে পরিপাটি হয়ে বের হয়েছে। ঘরে ঘরে অ্যাটাচড বাথ। রূপক ঘরে নেই। ঘরে ঢোকার আগে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল।
বাড়িটা এত সুন্দর, আর এই বৃদ্ধা বাড়িটাতে কেন যে আছে! না থাকলে কি ক্ষতি ছিল! বাড়ির এক কোণায় পড়ে থাকলেও যেন এক কদর্য অনুভূতি সারা বাড়িটায় ছড়িয়ে রেখেছে।