জতু অগত্যা কী করে। লাফ দিয়ে শেকড় থেকে নেমে ভেজা সায়া শাড়ি তুলে রাখল ঘাটলায়।
জতু দ্যাখ, আমি ঠিক ডুবে যাচ্ছি কি না।
কমলবউ ডুব দিল। জলের নাচে তার নগ্ন ফর্সা শরীর সাপের মতো কিলবিল করে এগিয়ে যাচ্ছে।
কমলবউ ডুব সাঁতারে-চিৎ সাঁতারে বড় পটু। তার হাত পা পিঠ দেখা যাচ্ছে। জলে ডুব দিচ্ছে, ভেসে উঠছে। সাঁতার কেটে মাঝপুকুরে চলে যাচ্ছে।
মাঝপুকুর থেকেই চিৎকার করছে, জতু আমি ঠিক ডুবে যাচ্ছি তো! হ্যাংলার মতো জতু চিৎকার করে উঠল, তুমি কোথায়?
ঠিক টের পেয়েছে কমলবউ, জতু ভয় পেয়ে গেছে।
আমি এখানে। বলে কচুরিপানার ভেতর থেকে ভুস করে ভেসে উঠল কমলবউ। কমলবউ তুমি মাঝপুকুরে চলে যাচ্ছ কেন! আর যেও না। ওদিকে বড়ো বড়ো কচুরিপানা, শ্যাওলা, আটকে গেলে ডুবে যাবে। দূরে নদীর জল, জোয়ার, সেখানে পড়ে গেলে ভেসে যাবে।
কমলবউ, ফের কচুরিপানার ভিতর থেকেই হাত তুলে বলল, আমি ঠিক ডুবে যাচ্ছি তো?
তুমি ফিরে এসো কমলবউ। আর যেয়ো না।
কমলবউয়ের আর সাড়া পাওয়া গেল না। কচুরিপানার ভিতর থেকে, হাতও তুলে দিল। কোমর সমান উঁচু কচুরিপানা পার হয়ে যাওয়াও সম্ভব নয়। সম্ভব হলেও পুকুরের শ্যাওলা-দামে কিংবা লতাগুলো আটকে যাবে। জলে ডুবে মরে যাবে। লাশ হয়ে ভেসে উঠবে। জতু যে কী করে! জতুর কান্না পাচ্ছিল।
পুকুরের ওপাড়ে যাবে তারও উপায় নেই। জল আর জল, গভীর জল—সামনে যত দূর চোখ যায় জলাভূমি নদী আর তার জলরাশি বেগে নেমে যাচ্ছে। ঘাটলায় শাড়ি সায়া সেমিজ পড়ে আছে—জতু কাউকে ডাকতেও পারছে না। কেবল মাঝে মাঝে চিৎকার করছে, কমলবউ আমার ভালো লাগছে না।
আমি চলে যাচ্ছি। পড়ে থাকল তোমার জামাকাপড়। কী আরম্ভ করলে!
জলের উপর দিয়ে দুটো ফড়িং উড়ে গেল। নিস্তরঙ্গ জলে ঢেউ উঠল। কিন্তু কমলবউ হাত তুলে, কিংবা ডুব সাঁতারে পায়ের কাছে এসে ভেসে উঠল না।
জতু ছুটছে। জতু চিৎকার করছে কমলবউ জলে ডুবে গেছে। যতীন দাস পাগলের মতো ছুটে বের হয়ে এল। মা জ্যেঠিরা সবাই। খবর ছড়িয়ে পড়লে পুকুর পাড়ে ভিড় বেড়ে গেল। কিন্তু এই জলা জায়গায় খুঁজে দেখাও অসম্ভব। কোথায় পড়ে আছে কে জানে! জলে নেমে গেল কেউ কেউ। কচুরিপানা টেনে তুলে দেখা হল, লগায় খুঁচিয়ে কিংবা জলে ডুবে যতটা পারা যায় তাও দেখা গেল।
মাস্টারমশাই শুধু বললেন, নিমাইকে দেখছি না। সে কোথায়? সে কি বাসলেহর খোঁজে শহরে গেছে?
না হয় জলা জায়গায়, লাশ হলে ভেসে উঠবে। কাকপক্ষী তাড়া করবে। শকুনের ওড়াওড়ি শুরু হবে। জলে ডুবে গেলে ফুলে ফেঁপে ভেসে উঠবেই। না, কিছুই হল না। কেউ বলল, জলে ডুবেছে না ছাই, ভেগেছে। খোঁজো নিমাইকে। কোথায় গেল নিমাই, খোঁজো তাকে। থানা-পুলিশেও বাদ গেল না। জতুকে ডেকেও জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। ভেগে যাবে তো সায়া শাড়ি ফেলে যাবে কেন? লাজলজ্জা আছে না। জতুর এক কথা, আমি জানি না, আমি কিছু জানি না।
জ্যাঠামশাই বললেন, তোর সামনেই সায়া সেমিজ খুলে ফেলল। তুই পুরুষমানুষ না! কমল তো আচ্ছা বেহায়া মেয়ে দেখছি।
জতু দেখল, মা ক্ষোভে ফুঁসছে ঘরের মধ্যে। সে তার মাকে এতটা রেগে যেতে কখনও দেখেনি। কদিন থেকে মা খেতে বসেও খেতে পারেনি। বমি উঠে আসছে। জ্যাঠামশাইর মুখের উপর মা কথা বলে না, আজ কেন যে এত রেগে গেল।
শহর থেকে নিমাইদা আর ফেরেনি। শহরে খোঁজাখুজি হয়েছে, সেখানেও সে নেই। যতীন দাস ভেজা সায়া শাড়ি তুলে নিয়ে গেছে। রোদে শুকিয়ে জায়গারটা জায়গায় রেখে দিয়েছে! জলা জায়গার স্বভাবই এরকম, কিছুদিন উত্তেজনা–তারপর সব থিতিয়ে যায়। যতীন দাস ফের নতুন একটি বউ ঘরে তুলে এনেছে। ভুরিভোজের আয়োজন যথেষ্ট। যে খেয়েছে সেই বলেছে, বউটি বড়ো সুন্দর হে যতীন। নজর আছে তোমার!
অন্নপূর্ণা
প্রণাম করো। তোমার দিদিশাশুড়ি। ভিড় থেকে আত্মীয়-পরিজনের কে কথাটা বললেন চাঁপা বুঝতে পারল না। প্রায় অন্ধকার ঘরে তিনি শুয়ে আছেন। ঘরে ওষুধের গন্ধ। ডেটলের গন্ধ কিংবা ফিনাইলের গন্ধ, ঠিক কীসের গন্ধ সে বুঝতে পারছে না। সারা রাস্তায় ট্রেনের ধকল গেছে, বিয়ের পাট চুকতে হোমের কাজ শেষ করতে প্রায় রাত কাবার। সারারাত ঘুমোয়নি। সকালেও বান্ধবীরা ছেড়ে যায়নি, ঠাট্টাতামাশায় তাকে উদব্যস্ত করে রেখেছিল। ট্রেনে সামান্য ঝিমুনি, ঘুম বলতে এইটুকু।
শেষে এই বাড়ি।
বাবা বলছেন, এখন থেকে আমরা আর তোমার কেউ না। বাবাজীবনের হাত ধরে বলেছেন, দ্যাখো বাবা ভুলত্রুটি হলে শুধরে নিও। বেয়াইকে বলেছেন, আমার ঘর খালি হয়ে গেল, আপনার ঘর ভরে গেল। আপনি ভাগ্যবান।
এমন সব নানা কথাই মনে পড়েছিল তার। শেষ পর্যন্ত প্রায় অন্ধকার ঘরে কারা তাকে যে নিয়ে এল! পাশে রূপক আছে এই রক্ষা। সে এখনও কাউকেই নিজের মনে করতে পারছে না। অপরিচিত মানুষজন যে যা বলছে করে যাচ্ছে।
রূপক বলল, দাঁড়িয়ে থাকলে কেন। প্রণাম করো। আমার ঠাকুরমা। বৃদ্ধা উঠে বসার চেষ্টা করছেন। তারপর কেমন মিনমিনে গলায় বললেন, কাপড়টা পরতে দে বাবা। বোধহয় এতই কাহিল, সারাদিন এই ঘরটা থেকে নড়তে পারেন না। অস্থিচর্ম সার এই বৃদ্ধাকে প্রণাম করার সময় কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছিল। চোখ কোটর গত। চুল শণের মতে, নাতবউকে একজোড়া বালা দিয়ে আশীর্বাদ করলেন। রূপকের সম্পর্কে এক পিসি বালাজোড়া পরিয়ে দিল। সে তো কিছু বলতে পারছে না। বুড়ি ঠাকুমার দিকে তাকাতে পর্যন্ত ভয় পাচ্ছে। বুকের হাড়-পাঁজর দেখা যায়, কতক্ষণে বের হয়ে আসবে।