আমি বলেছিলাম, কচু হবে দেখিস!
তারপরও কিছু করণীয় থাকে।
এবং বাকসিদ্ধ মানুষের এই এক বিড়ম্বনা। কুপিত অবস্থায় একরকম, মন শান্ত হলে অন্যরকম। অনুশোচনায় মাথা থারাপ হয়ে যায় ঠাকুরের। সবই অমোঘ ঈশ্বরবিশ্বাস হেতু। তিনি জানেন তাঁর কথা মিথ্যে হয় না। তিনি দিনের পর দিন অনশনে থাকলেন। মা জগদম্বাকে তুষ্ট করার জন্য হোমের আয়োজন, সারা দিন উপবাস থেকে সেই হোমে অপাবৃত অবস্থায় মন্ত্র উচ্চারণ করালেন ঈশাকে দিয়ে, অঘোরমন্ত্রে দীক্ষিত করালেন, বাক্যদোষ খণ্ডনে শাস্ত্রমতে যা যা করণীয়, কিছুই বাদ দিলেন না।
ঈশা-ই তাকে সব খুলে বলেছে।
ছোড়া কাউকে বোলো না। বললে মন্ত্রশক্তি নষ্ট হয়ে যায়।
তখনই ঝড়ঝাপটা আর বজ্রপাতের মধ্যে নদীর মাঝখানে স্টিমার চরায় ঠেকে গেছে। আশ্রমের পাশেই হাট, এবং মাছ ধরতে আসা সব নৌকাই ডাঙায় তুলে দিয়ে সবাই এসে আশ্রয় নিচ্ছে আশ্রমে, আর তখনই স্টিমার থেকে বার বার আর্তনাদের মতো ভোঁ ভোঁ আওয়াজ। ভয়ঙ্কর বিপদসূচক বার্তা পাঠাচ্ছে। কেউ স্থির থাকতে পারছে না। ঠাকুর শুধু বললেন, প্রলয়কালে এমনই হয়ে থাকে।
তারপর তিনি, আরও যারা ঝড়ের আতঙ্ক থেকে আত্মরক্ষার্থে আশ্রমের ঘাটে উঠে এসেছিল তারা—নিরাময়দা তো আছেনই, টর্চ হাতে আশ্রম থেকে নেমে গেলেন। জীবন বাজি রেখে আমরাও নেমে গেলাম। আর চারপাশে টর্চ জ্বেলে খুঁজতে থাকলাম, কোনো জলে ডোবা মানুষ যদি নদীর পাড়ে পড়ে থাকে।
নদীর পাড় অনতিক্রম্য। এখানে সেখানে সব গাছপালা পড়ে আছে। ডাল পাতা সব বেগে ধেয়ে যাচ্ছে। ঠাকুর কেবল মা জগদম্বার নাম নিচ্ছেন। তুমিই অগতির গতি। স্টিমারের আলো নিভে গেছে, অন্ধকারে বোঝাই যাচ্ছে না, নদীর কোন চরায় স্টিমারটা আটকে গেল। বিদ্যুৎ চমকালে বোঝা যাচ্ছে, যাত্রীরা প্রাণ হাতে তরঙ্গসঙ্কুল নদীতে ঝাঁপ দিচ্ছে। আর তখনই নিরাময়দা এবং আর কেউ কেউ, এমনকী আমরাও আশ্রমে উঠে এসে নদীতে নৌকা ভাসিয়ে দিলাম। আমার মাথা খারাপ অবস্থা—ডাকছি ঈশা, ঈশা, আমরা নদীতে আছি, তুই কি স্টিমারে? ঈশা, ঈশা। নিরাময়দার চিৎকার থাম থাম। ওই দ্যাখ ভেসে যাচ্ছে, আমরা এক এক করে তুলছি, আর আশ্রমে এনে শুইয়ে দিচ্ছি। জীবিত, মৃত কেউ বাদ যাচ্ছে না। এতগুলি নৌকা একসঙ্গে উদ্ধার কার্যে নামলে যা হয়, ঈশার কথা কেউ আর মনে রাখে না।
ঝড়ের প্রকোপ কমে আসছে।
কিছু মানুষজন সাঁতরে পাড়ে উঠে আসছে।
বৈদ্যেরবাজার থেকে থানার দারোগাবাবু সব সেপাইদের নিয়ে ত্রাণের কাজে নেমে পড়েছেন। বড় টর্চের আলোয় নদীতে জলে ডোবা মানুষ খুঁজে বেড়াচ্ছে তারা। আর আমি পাগলের মতো এক নৌকা থেকে আর এক নৌকায় লাফিয়ে পড়ছি। আর ডাকছি, ঈশা। ঈশা। তুই কোথায়! আর নানা প্রশ্ন, পিসিমা, পিসেমশাই এল না কেন? একা চলে এলি! তোর সঙ্গে আর কে আছে?
নিরাময়দা সারেঙকে হুইলঘরে পেয়ে গেছেন। ডেকছাদে তাঁরও ছোটাছুটি কম না। জনে জনে লাইফবেল্ট লাইফ বয়া দেওয়া, শিশু, নারীকে আগে বোটে পার করে দেওয়া, তাঁর লস্করদের নিয়ে তিনি এখানে সেখানে কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন, ঘুটঘুটে অন্ধকারে কিছু বোঝাও যাচ্ছে না। নিরাময়দার গলা পাওয়া যাচ্ছে।
সারেঙসাব ঈশাদির আসার কথা, সে কোথায়?
সারেঙসাব আর্তগলায় বললেন, ঈশাদি কথা শুনল না। চরায় ধাক্কা খেয়ে স্টিমার দু-টুকরো। কে কোথায় ডুবেছে, কী ভেসেছে—জানি না। নদীর কঠিন তরঙ্গ দফে দফে ডেকছাদ সাফ করে নিয়ে গেছে। তরঙ্গ উঠে আসার ফাঁকে ছোটাছুটি করছি, ঈশাদির সঙ্গে গগন এসেছে।
গগন পিসেমশায়েরই বিশ্বস্ত কর্মচারী, প্রৌঢ় মানুষ।
কোথায় গেল!
ঝড়ের মধ্যেই খ্যাপা নদীতে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ল।
ঈশাকে সারেঙসাব চিনতেই পারেন। কেবিনের যাত্রী ঈশা। ডেকছাদে মাত্র তিনটে কেবিন। সব কেবিনগুলোর দরজাই ফাঁক হয়ে আছে। আর কড় কড় শব্দ উঠছে। সব কেবিনগুলিতেই উঁকি দিলাম, সব ফাঁকা।
সারেঙসাব ছুটে এসে বললেন, ঈশাদি আমার বলল, আমি সাঁতার জানি। এই তরঙ্গসঙ্কুল নদীকে সে ভয় পায় না। সামনের আশ্রমে ঠিক সে উঠে যেতে পারবে।
হায় কপাল, তালগাছ প্রমাণ সব ঢেউ, ঈশা তো জানে না তাকে কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। সে কারও কথা শোনার বান্দা যে না আমিও বড়ো হতে হতে কতবার টের পেয়েছি। ছোটোদাদু আমাদের দুজনকে একসঙ্গে দেখলেই ফোকলা দাঁতে হাসতেন।—এই দুপুরের রোদে কোথায় যাওয়া হচ্ছে। তোর মাকে ডাকছি ঈশা।
ডাকো না। সঙ্গে ছোড়দা আছে।
ভিতরে প্রাণসৃষ্টির মধুমালা কুব কুব করে ডাকছে যে, কে আর আটকায় দিদি তোকে।
ইশা তাকায় আমার দিকে।
আমিও। তারপরই ঈশা ছুটে আমার সঙ্গে উঠে যেত ছাড়াবাড়িতে। ছোটোদাদু বলতেন, প্রাণসৃষ্টির পুঁথির পাতাটি খুলে গেছে, কী মজা!
এই সব কথাই মনে হচ্ছিল। ভিতরে হায় হায় করছিলাম। আমি ডাকছি, ঈশা, ঈশা। ঈশাকে খুঁজে পাওয়ার জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। ঈশার নানা উপদ্রব আমার কাছে এখন জীবনের মাধুর্য। আমি তখন আর এক খ্যাপা। তরঙ্গ উঠে আসছে নদীর। নৌকার চেয়ে এই তরঙ্গমলায় ভেসে যাওয়া সহজ।
সব তরঙ্গই নদীর কিনারে আছড়ে পড়ছে।
আর আশ্রমে উঠেই শুনলাম, কিছু জলে ডোবা মানুষকে তুলে আনা হয়েছে। কেউ মৃত কেউ অর্ধমৃত। সমস্ত আশ্রম জুড়ে মানুষের কান্না এবং কোলাহল। সব ডে-লাইট জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঈশাকেও পাওয়া গেছে। নিরাময়দা বললেন, ঈশাকে মন্দিরের বারান্দায় শুইয়ে রাখা হয়েছে। মাথায় তুলে হরি ব্রহ্মচারী তাঁকে ঘোরালেন। কিছুটা জল উগলে দিল। তারপর নিস্তেজ। ঠাকুর পুণ্ডরীকাক্ষ তার নাড়ি ধরে বসে আছেন। আর কালীস্তোত্র জপ করছেন। তোরা গিয়ে ঈশার পাশে বোস। আমার দিকে তাকিয়ে নিরাময়দা সতর্ক করে দিলেন, পাগলামি করিস না। সব ভবিতব্য। ঈশার শিয়রে শান্ত হয়ে বোস। আমি বাড়ি যাচ্ছি খবর দিতে।