তখনই দেখলাম নদীর উত্তর-পশ্চিম কোণে এক প্রগাঢ় খণ্ডমেঘ উঠে আসছে। বর্ষাকালে প্রবল ঝড় হয়েই থাকে। বহু জনপদ ঝড়ের মুখে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। নিরাময়দা নৌকা থেকে নেমে যাবার সময় বলল ঠাকুরের কৃপায় মেঘ কেটে যাবে।
আমরাও লাফিয়ে নামলাম। দূরে আশ্রমের হ্যাজাকের আলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিশাল এলাকার এই ডাঙা জায়গা খ্যাপা নদীর কোনো রোষই প্রত্যাঘাত করতে পারে না। অজস্র বৃক্ষ, এবং এক খণ্ড অরণ্যও বলা চলে, দূরে সেই মহাশ্মশানে আজ কোনো চিতার আগুন দেখা গেল না, ঠাকুর পুণ্ডরীকাক্ষ মন্দিরের গর্ভগৃহে জপতপে বসেছেন, নিরাময়দা কেমন প্রমাদ গুনলেন—আশ্রমের হরি ব্রহ্মচারী দেখাশোনা করছে সব। তিনিই মন্দিরের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেলেন।
আশ্রমবাসীর সংখ্যা যথেষ্ট। নানারূপে তাঁরা আছেন। ছোটো ব্রহ্মচারী, বড়ো ব্রহ্মচারীরা নানা কাজে ব্যস্ত। তাদের একজন হরিঠাকুর কী ভেবে বললেন, চলুন অতিথি ভবনে বসবেন। জপ তপ সারতে ঠাকুরের দেরি হবে। ভবনটি বিশাল, মাঘ সংক্রান্তিতে এখানে মেলা হয়। তখন দূর দূর অঞ্চল থেকে এমনকী ঢাকা শহরের গণ্যমান্য পুণ্যার্থীরা এসেও ওঠেন। জাগ্রত দেবী। তাকে অবহেলা করা যায় না। কোনো পাটের আড়তদার ভবনটি জগদম্বার নামে তৈরি করে দিয়েছেন। সারা অঞ্চল জুড়ে ঠাকুরের মেলা শিষ্য। মন্দির, অশ্বত্থাগাছ, অতিথি ভবন, আর নদীর বিশাল ঘাটলা তো আছেই। এই সব দেখে আমরা হতবাক, কলাপাতায় তখনই কিছু প্রসাদ চলে এল। প্রসাদ শেষ হতে না হতেই, ঠাকুর স্বয়ং হাজির।
আমার নাতিরা কই?
একেবারে নিকট আত্মীয়ের মতো সাদাসিধে সরল কথাবার্তা।
তারপর বললেন, দিদির নাতিরা আমারও নাতি। দেখি। আমাদের সামনে হাঁটু গেড়ে বসলেন।
জটাজুটধারী এবং শ্মশ্রুমণ্ডিত মানুষটিকে কেন যে আর ভয় থাকল না। খবর পেয়ে লীলাবতী ভৈরবিও হাজির। কই দেখি অচল ভোলা উমারে।
যেন কত কাল আমাদের দেখার জন্য প্রতীক্ষায় ছিলেন। শেষে যে বিনোদিনী দিদি রাজি হয়েছেন, কারণ লীলাবতী বংশের কলঙ্ক, এমনও শুনেছি সামাজিক বাধানিষেধ অগ্রাহ্য করে বিধবা লীলাবতী এক কাপড়ে ট্যাবা ভট্টাচার্যের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ায় বংশের মুখে কালি পড়ে এবং সেই থেকে বিনোদিনীর পরিবার এবং তাঁর আত্মীয়স্বজন পারতপক্ষে এই আশ্রমের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখতে চায় না। লীলাবতী মরে গেছে এমনই চাউর হয়ে গেছিল।
সে যাইহোক, বলতে গেলে অনেক কথা হয়।
তিনি অর্থাৎ পুণ্ডরীকাক্ষ ঠাকুর বললেন, নদীতে তো ভাই তোমাদের যাওয়া হবে। উত্তর-পশ্চিম কোণ থেকে অতিকায় কালো মেঘে নদী আবৃত হয়ে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই নদী ঝড়ে খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যাবে। বহু প্রাণহানির আশঙ্কা আছে। নদী শান্ত না হলে তোমাদের ছাড়া যাবে না।
শত হলেও নিরাময়দার পুণ্ডরীকাক্ষ ঠাকুর বাকসিদ্ধ পুরুষ। তার কথাই শেষ কথা।
নিরাময়দা ঠাকুরের পাশে হাত জোড় করে বসে আছেন। শুধু ওঠার মুখে নিরাময়দা বললেন, যে আজ্ঞে বাবাঠাকুর। আর তখনই বাবাঠাকুর খুবই যেন আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে বললেন, ঈশা নারানগঞ্জের স্টিমারে রওনা হয়েছে অথচ স্টিমারের কোনো পাত্তা নেই। ঝড় কি নদীর মুখে শুরু হয়ে গেল।
তখনই বিদ্যুৎ চমকাল। কোথাও বাজ পড়ল, আর প্রলয় শুরু হয়ে গেল যেন। মহাপ্রলয় কাকে বলে। নদীর জল আশ্রমের ঘাটাল পার হয়ে অতিথিভবনের সিঁড়িতে ঢুকে গেল। এবং নদীর তরঙ্গমালায় নানাপ্রকারের বিদ্যুৎলতা সাপের ফণা তোলার মতো ভেসে যেতে লাগল। নদীর জল ফুলে ফেঁপে উঠছে। আর শোঁ শোঁ আওয়াজ। জানালা-দরজা বন্ধ। চারপাশে অন্ধকার নিস্তব্ধতা। ঈশা স্টিমারে রওনা হয়েছে–আমার ভেতর তোলপাড় শুরু হয়ে গেল ঈশার কথা ভেবে।
নিজের ভিতর নিজেই ছটফট করছি।
আমার পিসেমশায় হয়তো আশ্রমে খবর পাঠিয়েছেন, তাঁরা স্টিমারে রওনা দিয়েছেন, কারণ পূজার ছুটিতে কিংবা ঈশা যদি অন্য কোনো ছুটিছাটায়, অথবা বাড়ির কোনো উৎসবে, কারুর বিয়ে, অন্নপ্রাশন, বাস্তুপূজা এবং নানাবিধ পূজা সহযোগে উৎসব লেগেই থাকে। পিসেমশাই আসতে না পারলে পিসিমা ঈশাকে নিয়ে চলে আসবেনই, সঙ্গে বিশ্বস্ত কোনো কর্মচারী এবং আশ্রমের ঘাটে স্টিমার নোঙর ফেললে মন্দির দর্শন, ঠাকুরের পায়ে প্রণিপাত এবং রাত্রিবাস করে ফের সকালের নৌকোয় রওনা হওয়া।
ঈশার বন্য স্বভাবের কথা মনে পড়ছে।
মেয়েটা বলত, তুমি আমার ভালো না বাসলে একদিন দেখবে আমি মরে যাব।
কেন মরবি? মরা কি এত সহজ?
ঠাকুর তো বলেছে, আমার মৃত্যু জলে ডুবে।
আজেবাজে কথা একদম বলবি না।
বলেছে বলছি।
কেন বলল। তুই কী করেছিলি! তুই তো সাঁতার জানিস?
সে দিনও মেঘনায় সাঁতার কাটছিলাম। বাবার কী মানত ছিল! দুদিন তিনি আশ্রমে ছিলেন। পাঁঠাবলি হবে শুনে, আমার রাগ, পাঁঠাবলি কেন?
ঠাকুর খুবই কুপিত।
শোনো ঈশা, সবই মা জগদম্বার ইচ্ছা। তিনি যা চান দিতে হয়। গোলমাল করে পূজার বিঘ্ন ঘটিও না।
কে শোনে কার কথা।
ছাগ শিশুটির আত্মরক্ষার্থে কোলে নিয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। বৈশাখ মাস, নদীতে হাঁটু জল। নদীর ওপারের চরে ছেড়ে দিয়ে এসেছিলাম। জল থেকে উঠে আসার সময় কুপিত হয়ে বললেন, নদীর জলেই তোমার মরণ ঈশা। মা জগদম্বার ইচ্ছার বিরোধী তুমি। তোমার জন্য আমার নিজেরই কষ্ট হচ্ছে। মুখ থেকে কথাটা কী করে যে ফসকে বের হয়ে গেল।