তা পারবে না কেন? আমি পারব না। বড়দাকে বল।
শোন ছোড়দা, আমাকে তোয়াজ করতে হলেও সে আমাকে ছোড়দা ডাকত।
বড়দাকে দিয়ে হবে না। সে কিছু জানে না। কিছু বোঝে না। কারও কালি আমার সহ্য হয় না। বড়দার এটা আছে।
জান বড়দা আমার চেয়েও সাঁতারে বেশি পটু।
কিন্তু ঈশা নাছোড়বান্দা, সে অগত্যা তার মাকে ডেকে বলল, দ্যাখ মা ছোড়দা আমাকে সাঁতার শেখাবে না বলছে।
আরে যা না। তোকে ছাড়া তো কোথাও নড়ে না। সাঁতার শেখাতে তোর আপত্তি কেন!
আপত্তি কেন, কী যে বলি। টুকুস করে চুমু খায়, বলে সাপটে ধর, ধর, আরও জোরে, আমাকে পিষে মেরে ফেলতে পারিস না। হস্তপদ নিয়ে গজ হয়ে গেছিস। কিছু কি তুই বুঝিস না। কিছু কি তোর নেই!
মেয়েটা এত ভালো, অথচ মাঝে মাঝে কী যে হয়। বাড়ির ভালো-মন্দ খাবার সে রান্নাবাড়ি থেকে তুলে এনে ঠাকুরঘরের পেছনে খাওয়ায়। বলে সব স্বার্থপর ছোড়দা। কেউ তোর কথা ভাবে না। বলতে বলতে সহসা ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলে। সে গতবারে একটি ঝরনা কলম দিয়ে বলেছে, আমার জন্য মন খারাপ হলে চিঠি লিখবি কীরে লিখবি তো। আমার কত রকমের ইচ্ছা হয় জানিস। ভাবলে আমার নিজেরই লজ্জা লাগে। চল ছোড়দা। তারপর ফিস ফিস করে বলবে, আমি কিছু করব না। সঙ্গে সঙ্গে আমার মাথা কেমন ঝিম ঝিম করতে থাকে। ছাড়াবাড়িটি সাঁতার শেখার পক্ষে প্রকৃষ্ট জায়গা। বর্ষাকালে কোমর জল থাকে। ডুবে যাবার আশঙ্কা থাকে না। ভাদ্র মাসে পুকুরে এক লগি জল, হাত ফসকে গেলে ডুবে যেতেই পারে। তার কথা ভেবেই শেষে রাজি হওয়া।
কিন্তু মুশকিল সাঁতার শিখতে গিয়ে তার বায়না—এই ছোড়দা আমার হিসি পেয়েছে।
নাম জলে। কেউ দেখতে পাবে না।
ভয় করে। তুই নাম।
কোষা নৌকায় ছাড়াবাড়িতে যেতে হয়। নৌকা থেকে অগত্যা জলে লাফিয়ে নামতে হয়। কীসের সাঁতার শেখা। সে জলে নেমে হুটোপুটি শুরু করে দেয়। আর আমার শরীরের সঙ্গে লেগে থাকতে চায়। আমার মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করে। তবু কেন যে এক সময় তার কোমর ধরে বুকজলে দাঁড়িয়ে থাকি। আর তার যে কী হয়, সে আমার হাত ঠেলে আরও নীচে নামাতে গিয়ে কেমন অস্থির হয়ে পড়ে। তারপর কিছুটা বেহুঁশের মতোই বলে, আমি ডুবে যাব। তুই আমাকে জড়িয়ে ধর। আমি দিশেহারা হয়ে যাচ্ছি।
সে যেহেতু আমার জন্য এত করে, আমিও তার উত্তেজনা লাঘবের জন্য কিছুটা সাহায্য করি। এটাই ছিল ঈশার সাঁতার শেখার প্রক্রিয়া। ধীরে ধীরে সে সাঁতারও শিখে যায়। এবং বুঝতে পারি আমরা সত্যি বড়ো হয়ে গেছি। ঈশা আর আমার দিকে বাড়িতে চোখ তুলে তাকাতে পারে না। কথা বলতে পারে না। চোখের এই ভাষায় বড় হওয়ার কথা থাকে, তাও বুঝি। শরীরে ইচ্ছে অনিচ্ছে নানাভাবে বিচ্ছুরিত হতে থাকে। পূজার ছুটি হলেই তার আসার অপেক্ষা করি। এবারেও প্রায় তাই। দূরে দূরে সব জলময় মাঠ। কোনো ছই দেওয়া নৌকা দেখলেই ছুটে যাই। সময় কাটে না।
নিরাময়দা ঢাইন মাছ শিকারে নিয়ে না এলে এক ছন্নছাড়া মানুষের মতো বাড়ির ঘাটলায় চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া উপায় থাকে না।
সামান্য বড়ো হয়ে ওঠার মুখেই সে যে কী গন্ধ পেয়ে গেল আমার শরীরে। আমি হাটে যাব নিরাময়দা সঙ্গে—সেও আমার সঙ্গ নেবে।
খেলার মাঠেও তাই।
সুপুরি গাছে ওঠারও সাধ তার। প্রায়ই বলবে, তুই সঙ্গে থাকলেই আমার কেন যে এত হিসি পায়! প্যান্টিটা ধর। আমি সুপুরি গাছে উঠব। সুপুরি গাছে চড়া শিখব। সুপুরি গাছে সহজে ওঠা যায় না। কিছুটা উঠলেই হড়হড় করে পড়ে যেতে হয়। প্রকৃতই তার প্যান্ট ভিজা ভিজা থাকে।
কত ছবি হয়ে আছে সেই সব দৃশ্য কিংবা দুই বালক-বালিকা, পুজার সময় প্রকৃতির মধ্যে বড়ো হয়ে উঠছে—এক অষ্টমী পূজায় ঈশাকে কুমারী পূজাও করা হয়। এমন বন্য স্বভাবের মেয়ে যদি দুর্গা মণ্ডপে কুমারী সেজে বসে থাকে, তার পূজাআর্চা হয়, বড়ো বড়ো পদ্মফুলের সিংহাসনে এক দেবীকন্যা, কে বলবে তার মধ্যে পাক খাচ্ছে প্রকৃতির নানা কূটকামড়, পূজা আসলেই আমার এখনো মন খারাপ হয়ে যায়।
নিরাময়দা বলল, এসে গেছি।
আমাদের কোষা নৌকা খুব একটা বড়ো নয়। চারজন আমরা, নৌকা বড়ো হলে নদীর উজানে উঠে যাওয়া খুব কষ্টসাধ্য—নৌকা যত ছোটো হয়, ততই জলে নৌকা ভাসিয়ে নিতে সুবিধে। শত হলেও মাছে-মানুষে লড়াই কপালে থাকলে দু-মনি, আড়াই-মনি ওজনের মাছও লেগে যেতে পারে। পরিণামে নৌকাডুবি হয়। নদীর তরঙ্গে ভেসে কিংবা পাতালে অদৃশ্য হয়ে যাবার সম্ভাবনাও থাকে। ঠিক হয়ে আছে, রাতে আশ্রমে আহার এবং ঠাকুরের ফুল বেলপাতার আশীর্বাদ, এবং ঠাকুমার সেই ট্যাবা, যিনি এখন নিরাময়দার পুণ্ডরীকাক্ষ অর্থাৎ বিষ্ণুর অবতার, তার অনুমতি নিয়ে ভোররাতে ভাটার মুখে জয় মা জগদম্বা বলে নদীর বুকে বড়শি ছুঁড়ে দিয়ে বসে থাকা। গভীর জলে বড়শিতে আরশোলা গেঁথে, সেই কোন গভীরজলে ছুঁড়ে দেওয়া।
তারপর গভীর জলের নীচে বড়শি আরশোলার টোপ নিয়ে অপেক্ষা করবে, এবং শয়ে শয়ে নৌকায় এই মাছ শিকার এক আশ্চর্য রোমাঞ্চকর ঘটনা। মাছে মানষে লড়ালডি, মাছ আটকে গেলে মাছে-মানষে খণ্ডযুদ্ধ। প্রবল সেই রোমাঞ্চ শরীরে শিহরণ খেলে যাবার মতো—ঈশার সেই সাঁতার শেখা কিংবা সুপুরি গাছ বেয়ে ওঠার মতো আশ্চর্য এক স্তব্ধতার অনুভূতি–