আমাদের কোষানৌকা তখন পদ্ম আর শাপলা শালুকের বিলে ঢুকে গেছে। নদীতে সূর্য ডুবছে। এই বিল পার হলেই সংসারদির পুল। তারপরই সেই ডাঙা দেখা যাবে। বড়দা হালে বসে আছে। মেজদা আর নিরাময়দা বৈঠা মেরে পদ্মবন পার হয়ে যাচ্ছে। আমি চুপচাপ বসে আছি পাটাতনে—চারপাশে জলাভূমি আর অজস্র পাখির কলরব। তারা এতক্ষণ বিলের জলে ওড়াউড়ি করছিল। পোকামাকড় এবং মাছ ভেসে উঠলে, যেমন কিছু চিল এবং তার সঙ্গে দু-চারটি ঈগল পাখিও আছে, বিলের জল থেকে একটা ঈগল বিশাল ডানা মেলে জল থেকে ঝুপ করে তুলে নিয়েছে অতিকায় একটা মাছ এবং উড়ছে। জলা জায়গা বলে কোনো গাছপালা চোখে পড়ছে না। দূরের আশ্রমে দেখা যাচ্ছে, সব বড়ো বড়ো বৃক্ষ, এই তাজ্জব করা জায়গায় এসে কেমন একটা আশ্চর্য মোহ তৈরি হয়। পুণ্ডরীকাক্ষ কথাটার অর্থ কী জানতে ইচ্ছে হয়।
নিরাময়দা বললেন, আর বেশি দূর না। সূর্য ডুবতে না ডুবতেই আশ্রমের ডাঙ্গা পেয়ে যাব। কী রে ভোলা, পাটাতনে বসে যে একেবারে ভাবলু বনে গেলি!
আমি যে ঈশার কথা ভাবছিলাম নিরাময়দা হয়তো টের পেয়ে গেছেন। আমি সোজা হয়ে বসলাম।
বল। মনে হয় কোনো সংশয়ে ভুগছিস?
বললাম, না মানে—
আরে মানে মানে করিস না। সব তাঁরই কৃপা।
কৃপা কেন।
তিনি তো ধরণীর তাবৎ সুখ-দূঃখের অধিকারী।
আচ্ছা কাকা, পুণ্ডরীকাক্ষ কাকে বলে?
বিষ্ণু অবতার।
এত খবর তুমি দাও, এত বড়ো একজন দেবতা নদীর পারে আশ্রম বানিয়ে বসে আছে বলোনি তো। আমার কথাবার্তায় ঈশাকে সম্পূর্ণ আড়াল করে গেলাম।
তোরা ছেলেমানুষ, কেবল স্কুল আর বিদ্যাশিক্ষা আর বছর বছর ফেলমারা। তার বাইরেও এক বড়ো জগৎ বিদ্যমান—সোজা হয়ে বোস। সব ঠিকঠাক আছে, কপালে সব লেখা থাকে। ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর এই তিন অবতার বুঝলি, আমাদের ঠাকুর বিষ্ণুর অংশ। আশ্রমে ঢুকে প্রথমেই তাঁকে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত। সব বিপদ কেটে যাবে। আশীর্বাদে তাঁর পরীক্ষায় ভালো ফল করবি। তোদের চড়চড়ে কপালে বিদ্যুৎ রেখা ভেসে উঠবে। তিনি মঙ্গলময়। যত বড়ো মাছই শিকার করি না কেন, তিনি আছেন সর্বত্র। তিনিই আমাদের হয়ে মাছটাকে দেখবি কবজা করে ফেলবেন। মাছ শিকারে আমাদের কোনো বিঘ্ন ঘটবে না।
ঢাইন মাছ ধরার উত্তেজনা তো আছেই, তার উপর ঈশা, আমি ঈশাই ডাকতাম–তুই তুকারিও চলত, তবে ঈশা আমার চেয়ে কিছু বড়ো। ঠাকুমা জেঠিমা সবারই এক অভিযোগ, তুই কীরে, তুই নাম ধরে ডাকছিস? ঈশাদি ডাকতে পারিস না। ঈশাদি বলত, নারে, তুই আমার নাম ধরেই ডাকবি। দিদিফিদি আমার ভালো লাগে না।
নিরাময়দা বললেন, তোর পিসির পাত্তা নেই, তোর ঈশাদিও আসছে না, কী ব্যাপার!
আসলে আমাদের সবারই আগ্রহ আছে ঈশার সম্পর্কে। পূজার ছুটিতে পিসেমশাই সবার জন্য জামাকাপড় নিয়ে আসেন। আজকাল ঈশাই নাকি সব পছন্দ করে কেনে। আমার ওপর বাড়ির সবাই একটু বেশি সদয়। কারণ পরিবারে আমি পিতৃমাতৃহীন। জেঠিমা কাকিমার আদরেই বড়ো হয়েছি। ঈশা এলে সে আমাকে ছাড়া কোথাও এক পা নড়বে না। আমার পিসেমশাইয়ের ঢাকা শহরের বাংলা বাজারে বিশাল গারমেন্টের দোকান। ঈশা তার বাবা-মায়ের সবেধন নীলমণি। তার আবদার কারও কাছে হেলাফেলার নয়। আর আমি যে বড়ো হয়ে গেছি, বছর দুই আগে ঈশাই বুঝিয়ে দিয়েছিল। সে আমাকে ছাড়াবাড়িতে সাপটে ধেরে টকাস করে চুমু খেয়েছিল।
ঈশা সম্পর্কে নিরাময়দার আসল আগ্রহ, পূজার জামাকাপড় তিনি তার হাত থেকেই পেয়ে থাকেন। ঈশার পছন্দের তিনি খুব প্রশংসা করে থাকেন। ঈশাদির রুচি আছে এমনও বলেন। আর ঈশা যে রহস্যময়ী নারী হয়ে যাচ্ছে গতবারের পুজোয় তা ভালোই টের পেয়েছি। এই করে কেন যে মেয়েটার জন্য আমার এত টান—এবং কখনো মনে হয় আর কেউ না থাকুক ঈশা আছে। সে আরও কিছু চায় আমার কাছে। ঈশার কথা ভাবলেই মন খারাপ হয়ে যায়।
আসলে তরুপিসি ঠাকুমার পালিতা কন্যা। ঠাকুমার কোনো কন্যাসন্তান না থাকায় তরুপিসি এ-বাড়িতে আশ্রয় পান। এবং আমার বাবা-কাকারাই তরুপিসির বিয়েও দেন। এই তো সকালে ঠাকুমাই বললেন, পরের মেয়ে এত করে, তোমরা বউমারা কি তার জন্য এতটুকু ভাব! তারা আসছে না কেন, খোঁজখবর নিতে হয়। না!
বড়ো জেঠি বলল, আপনার ছেলে তো জানে। ডেকে জিজ্ঞেস করুন না।
হ্যাঁরে উপেন শুরু কবে আসবে। পূজার ছুটি পড়ে গেছে। ওদের কারও শরীর খারাপ হয়নি তো!
না না। ভালোই আছে। ঈশার পূজার ছুটি একটু দেরিতেই হয়। জান না!
আমাদের ছাড়াবাড়িটা প্রকৃতই নিঝুম। আট-দশ বিঘার ছাড়াবাড়িতে নানা ফলের গাছ। আম, আতা, লিচু, কাঁঠাল কী নেই! সফেদা গাছও আছে। খালের ধারে কিছু জঙ্গলও আছে আর আছে বড়ো বড়ো শিমুল, নিম, রসুনগোটার গাছ। কত রকমের যে গাছ! সুপারি গাছও মেলা। ঈশার বড়ো প্রিয় এই ছাড়াবাড়ি। বর্ষায় জলে ডুবে যায় জায়গাটা। ঈশার খুব সাঁতার শেখার শখ। সে আমাকে নিয়ে কিছু ভাবলেই তলব–
এই ছোড়দা চল। ছোটো ভাইবোনেরা ছোড়দা ডাকে। ঈশাও ডাকে—এটা তার আবদার।
কোথায়!
ছাড়াবাড়িতে। আমাকে সাঁতার শেখাবি।
ধেড়ে মেয়ে, আমি পারব না।
ওমা। ধেড়ে মেয়ে বলায় কী রাগ। ফুঁসে উঠেছে।
আমাকে তুই ধেড়ে মেয়ে বললি! ধেড়ে মেয়ে হলেই বা কি! ধেড়ে মেয়েরা কী সাঁতার শিখতে পারে না!