নিরাময়দা তুমি আমাদের নিয়ে যাবে না?
তিনি তখন টোনসুতোয় গাবের কষ খাওয়াচ্ছেন। ঘাটের গাবগাছে সুতোর একমাথা গিঁট দিয়ে বাঁধা। অন্য প্রান্ত বাড়ির উঠোনের অড়হড় গাছের ডালে বেঁধে মৌজ করছেন। বঁড়শির গিঁট টেনে দেখছেন। চার-পাঁচটা বোয়ালে বঁড়শি দশির বাজার থেকে কিনে এনে তাদের দেখিয়েছেন। বঁড়শির কী তেজ! একবার গিলে ফেললে মাছের আর রক্ষে থাকবে না।
তুমি আমাদের নিয়ে যাবে কিনা বলো। কথার খেলাপ করবে না!
কোথায়!
আরে অদ্ভুত কথা বলছে তো!
বললে যে আরশোলা দু-কৌটা ধরে দিলে আমাদের মাছ শিকারে নিয়ে যাবে!
ছোটোকর্তা রাজি না। তোরা ছেলেমানুষ, মাছ ধরার ধকল সহ্য হবে না। পড়াশোনার ক্ষতি। পাশ না করলে খাবি কী!
তোমার কথা মতো আমরা দু-কৌটা আরশোলা ধরে দিলাম–
তোরা গেলে আমার কত সুবিধা। তারাপদ সকাল সকাল চলে আসবে বলেছে। সেই নদীর উজানে নৌকা তুলে নিয়ে যাবে। তারা পারবি না।
বড়দা বলল, আমরা পারব। নৌকায় আমরা স্কুলে যাই। সেও তো কত লম্বা রাস্তা। আমরা পারব না কেন?
ঠিক আছে। তোরা পারবি। তোরা বড়ো হয়ে গেছিস। ছোটোকর্তাকে বুঝিয়ে বললেই হবে। যা তো নৌকার পাটতনে সব সরঞ্জাম তুলে ফেল—চানটান করে নে। যদি পারি তোর পিসিকে ঈশাদিকে ফেরার সময় ঘাটে তুলে নেব।
মেজদা বলল, কাকা খেপে আছে। পিসির পাত্তা নেই। শহর থেকে শাড়ি, সায়া, জামাকাপড় নিয়ে আসে পিসি পিসেমশাই। আর ঈশাদি একাই একশো। পিসি পিসেমশাইর জন্য বাড়ির সবাই অপেক্ষা করে থাকে। তাদের পাত্তা নেই। খেপে তো থাকবেনই। পূজার জামাকাপড় বলে কথা! তাকে তুমি রাজি করাতে পারবে না। ফিরে এলে আমাদের সব কটাকে পেটাবে।
ঠিক আছে। আমি তো আছি। কর্তা ছাড়া আর কি কেউ বাড়িতে থাকে না! ঠাইনদিকে বললেই হবে।
ঠাইনদি অর্থাৎ আমাদের ঠাকুরমা। তিনি রাজি হলে কারও কিছু করার নেই। এই মাছ ধরা এক দুঃসাহসিক অভিযান। কোষা নৌকার পাটাতনে বসে থাকা, ঝড়বৃষ্টি আছে এবং ধাপে ধাপে নদীর জল পাগল হয়ে থাকে। মাছ পাগল হয়ে থাকে। বর্ষায় ঢাইন মাছের গর্ভসঞ্চার হয়। কারে খায় কারে রাখে ঠিক থাকে না। এই সময় এক একটা ঢাইন মাছ হাঙরের মতো বিশাল আকারের হয়। রুপোলি মাছ, মুখ কুঁচলো এবং টকটকে গভীর লাল, মাছ যদি বঁড়শিতে লেগে যায়, তাকে কবজা করতেই রাত কাবার হয়ে যেতে পারে। শিকারে গেলেই হয় না, তিথিনক্ষত্র দেখে বের হতে হয়। নিরাময়দা সব কাজই সুচারুভাবে সম্পন্ন করেছেন। কোষা নৌকার গলুইতে বড়ো বড়ো সিঁদুরের টিপ দিয়েছেন, বিশকরম বলে শুধু রওনা হয়ে যাওয়া।
নদীতে যাচ্ছি শুনে বাড়িতেও শোরগোল পড়ে গেল। মা জেঠিমারাও তেতে আছেন। নিরাময় তুই কী পাগল! এই ভাদ্রমাসের গরমে—রোদে ঝড়বৃষ্টিতে রওনা হলি!
আমার কী দোষ! ঠাইনদি যে কইল, নিয়া যা, নদীতে সবাই মাছ ধরতে যায়, আমার নাতিরা কী দোষ করল। পূজার ছুটি পড়ে গেছে—ঈশা এলে ওদের মজা কত বোঝ না!
আর কথা নাই। কথা বললেই সাতকাহন, নিরাময়দা শুধু বললেন, দেরি হইলে চিন্তা কইরেন না। মনে করবেন বঁড়শিতে মাছ আটকাইছে।
ঠাকুরমা বলল, আশ্রমে গিয়া ট্যাবারে কবি বিনোদিনী দিদি পাঠাইছে। সে তো শুনেছি দৈব লাভ করেছে। আমার তিন নাতির মাথায় যেন দেবী জগদম্বার আশীর্বাদী ফুল দেয়। দৈব বলেই জন্ম-মৃত্যু। কার জীবন কে যে নেয়। এত আতুপাতু ভালো না। নাতিরা বড়ো হচ্ছে, কত কিছু বুঝতে শিখেছে, তাদের বাধা দিতে নেই।
বেলা পড়তেই রওনা হওয়া গেল।
এই সময় জলে টান ধরে। চার পাশ এত দিন বর্ষায় মাঠঘাট নদীনালা সব ডুবে ছিল। নৌকা বাইতে বিশেষ কষ্ট ছিল না। জলে টান ধরায় নৌকায় লগি মারতে কষ্ট। নিরাময়দা সাহসী মানুষ, ভূতপ্রেতে বিশ্বাস আছে—তবে তিনি মনে করেন ভূতপ্রেত মানুষের কোনো অনিষ্ট করে না। মানুষই মানুষের অনিষ্ট করে, আবার উপকারও করে। নিরাময়দার এক কথা, আরে পুণ্ডরীকাক্ষ ঠাকুর যার সহায় তার ভয় কীসের।
আসলে ঠাকুমার ট্যাবা এখন শ্মশানে সিদ্ধি লাভ করে যে পুণ্ডরীকাক্ষ হয়ে গেছেন সেকথা আমাদের জানা ছিল না। মেজদাই বলল, বড়ো খটকা লাগছে।
কীসের খটকা।
ট্যাবা বলল কেন ঠাকুমা। ট্যাবা নাম হয় নাকি?
আরে আরে ঠাকুর তো ঠাকুমার দেশের লোক। ট্যাবা যে শেষে পুণ্ডরীকাক্ষ হয়ে যাবেন তিনিও জানতেন না। ঠাকুর তোদের নাকি একবার দেখতে চেয়েছিলেন। বিনোদিনী দিদির নাতিরা কত বড়ো হয়েছে দেখার খুব সাধ। এবারে মাছ শিকারও হবে, ঠাকুরের মনোবাঞ্ছাও পূরণ হবে। বুঝলি কিছু। বললাম, আমার মন ভালো না, ঈশা যে কবে আসবে! কেমন পাগল পাগল লাগছে। ঠাইনদি এক কথায় রাজি হয়ে গেল। ঠাকুরের আশ্রমে রাত যাপন করব শুনেই ঠাইনদি এক কথায় রাজি হয়ে গেল। —আশ্রমে কোনো বিপদ-আপদ থাকে না জানিস। তা ছাড়া ভৈরবী ঠাকরুন দেখবি তোদের কত আদরযত্ন করে খাওয়ায়। ঠাকুর আবার নদীরও দেবতা—তার প্রিয়জনদের অনিষ্ট হয় এমন কোনো কাজই করতে নদী সাহস পাবে না।
ঈশা এলে আমরা যে তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি, ঈশার পূজার ছুটি হয়তো পড়েনি, গ্রীষ্মের ছুটিতে আসতে পারে না, অনেকটা পথ হাঁটতে হয়। বর্ষায় নৌকা এলে ঘাটে লাগে—বড়োই সোহাগি মেয়ে ঈশা। আমি ঈশার কথাই ভাবছিলাম। কী সুন্দর মেয়ে, ফ্রক গায়ে দেয়। আমরা লম্বায় এখনো সমান সমান। সে এলেই আমার পাশে দাঁড়িয়ে মাপবে। সে কত লম্বা হয়েছে।