সঞ্চারী আর পারল না নিজেকে দমন করতে। সে বসার ঘরে ঢুকে চিৎকার করে বলতে থাকল, কেন আপনারা আসেন, এঁদের আপনি চেনেন না। এরা সব পেয়ে গেছে। কেউ দরজায় এসে দাঁড়ালে এদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে।
বাবা অবাক চোখে সঞ্চারীকে দেখছে। সঞ্চারী এত ক্ষিপ্ত হয়ে কখনো কথা বলে না।
আরে তোর এত রাগের কী হল! তুই খেপে যাচ্ছিস কেন। আমরা কতটা কী করতে পারি।
কতটা পারো, জানি না বাবা, যতটুকু পারি তাও আমরা করি না। সিঁড়ি ধরে নামার সময় সঞ্চারী বারান্দার আলো জালিয়ে দিয়ে বলল, অমিতবাবু, সাবধানে নামবেন। সিঁড়ির এ-জায়গাটায় অন্ধকার আছে। একটা গর্তও আছে। পড়ে-উড়ে পা খোঁড়া হলে পঙ্গু হয়ে যেতে পারেন। কে দেখবে তখন।
লোকটি পেছন ফিরে তাকাল। সঞ্চারী কেন যে মুখ ফিরিয়ে নিল। ধরা পড়ার ভয়ে, না অন্য কিছু।
ঈশা
মাথায় কোনো গল্প আসছে না। কী করি? আর তখনই তিনি এসে সামনে দাঁড়ান। অর্থাৎ নিরাময়দার কথা মনে হয়, ঈশার কথা মনে হয়। তারা সশরীরে যেন হাজির।
তাদের তো সশরীরে হাজির হবার কথা না। সেই কবে পুব-বাংলার এক জলা জায়গায় তাদের সঙ্গে আমার দেখা—দেখা বলা হয়তো ঠিক হবে না। কারণ তাদের শ্যেন নজর এড়িয়ে কোনো কুকাজ করাই আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। নিরাময়দাকে বাড়ির কাজের লোকও বলা যায়, আবার অভিভাবকও বলা যায়। আমাদের শৈশবে নিরাময়দা যে কত সম্ভব-অসম্ভবের গল্প বলে মনমেজাজ ভালো করে দিতেন এবং তার কথা ভাবলেই মগজে নানা গল্প তৈরি হয়। তাকে নিয়ে গল্পও লিখেছি, তবে ঈশার গল্প শেষ হয় না। বাড়িতে ঈশার আসার কথা থাকলেই আমি বড়ো অস্থির হয়ে পড়ি।
যেমন একবার নিরাময়দাকে কিছুতেই রাজি করাতে পারছিলাম না। তিনি ঢাইন মাছ শিকারে নদীতে যাবেন। আমরাও যাব। আমরা বলতে বড়দা, মেজদা আর ছোটদা। যে সে নদী না। মেঘনা নদী—বিশাল বিপুল জলরাশি নিয়ে সে কোথায় যে ছুটছে! বর্ষায় নদীর দু-পার দেখা যায় না। আর তার তরঙ্গমালার কী বাহার!
সেই তরঙ্গমালায় পড়ে গেলে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়। তবু কেন যে দেখার বাহার, বাহার অর্থাৎ জীবনের বাহার—স্টিমার, গাদাবোট, একমাল্লা, দোমাল্লা নৌকা, খাসি নৌকাও মেলা, পাল তুলে দিয়ে কোথায় যে তারা যায়।
গয়না নৌকাও থাকে। কলের গান বাজে-নদী তুমি কোথায় যাওরে। বর্ষায় আত্মীয়জনেরা আসেন। শহর থেকে দূর গ্রাম থেকে, পঁচিশ-তিরিশ ক্রোশ কোনো ব্যাপারই নয়। বড়ো পিসি ছোট পিসি, মামা-মামিরাও আসেন। আর আসে বড়ো পিসির মেয়ে ঈশা। সে আমাদেরই বয়সি।
নদীর পারে আমরা বড়ো হয়েছি।
ঠিক নদীর পারে বলা যাবে না। নদী থেকে এক ক্রোশ দূরে।
আমাদের গ্রামের মাঠ পার হলেই খোপেরবাগ, তারপর আর একখানা মাঠ, সেই মাঠে পড়লেই সংসারদি, তারপরই দামোদরদির মাঠ। সেখানে নদীর পাড়ে ডাঙার মতো জায়গায় শ্মশান এবং বটগাছ—যে সে বটগাছ নয়। বিশাল অশ্বখ গাছ বলাই ভালো—তার নীচে জটাজুটধারী এক মহাক্ষেপা পাগল, গৌরবর্ণ, কপালে সিঁদুর, বম বম ভোলানাথ ত্রিশূল হাতে নিয়ে বসে আছেন—নিশুতি রাতে শবদাহ হলে তার কষুকণ্ঠে চিৎকার জয় মা জগদম্বা, কারণ গাছের নীচে একটি মন্দিরে তিনি বসবাস করেন। সকালে জগদম্বার অন্নভোগ হয়। ভৈরবী লীলাবতী শুদ্ধ বস্ত্রে খিচুড়ি পায়েস লাবড়ার ভোগ দেন—এবং নিরাময়দার মুখেই সব শোনা —আমাদের অবশ্য সেখানে যাওয়া হয়নি। ঢাইন শিকার উপলক্ষে যদি সেই আশ্রম দেখার সৌভাগ্য হয়।
বাড়ির ছোটোকর্তার মেজাজ খারাপ। সকাল থেকে নিরাময়দাকে শাসাচ্ছেন, কাজকাম ফেলে চললি নদীতে। বড়দির আসার কথা–পূজার ছুটি পড়লেই তারা রওনা হবেন।
তারা মানে ঈশাও সঙ্গে থাকে। শহরের মেয়ে ঈশা। চঞ্চল, কৌতূহলী এবং বন্যপ্রকৃতির। আর আমাদের মধ্যে ঈশা এলে আশ্চর্য এক প্রাণের সাড়া পড়ে যায়। আমরা তিন জনই পানাস হাইস্কুলের উঁচু ক্লাশের ছাত্র। তাকে নিয়ে আমাদের মধ্যে বিচিত্র সব মান-অভিমানের পালাও জমে ওঠে।
তখন তাঁর এককথা, কী করি কন কর্তা! মাছের নেশা যার আছে সে জানে। শ্রাবণ-ভাদ্রি নদীর উজানে ঢাইন মাছেরা ঝাঁকে ঝাঁকে উঠে আসে। মাছেরা এই ‘জো’ আগামী পূর্ণিমা পর্যন্ত থাকবে। নদীর অতলে তেনারা উঠে আসছেন।
ছোটোকর্তার শাসানি থামছে না।—কাজকাম সেরে যাবি। খবরদার, অচল ভোলা উমা কেউ যেন আবার নৌকায় গিয়ে বসে না থাকে! ওদের সঙ্গে নিবি না। জ্বরজ্বালা হলে কে দেখবে। পড়ার ক্ষতি, একবারে তো একটাও পাশ করতে পারে না।
বড়দা তখন আমার দিকে তাকিয়ে বলল, হয়ে গেল। ছোটোকাকা খেপে আছে।
আমরা পশ্চিমের ঘরে পড়ছি, কাকার হম্বিতম্বিও কানে আসছে। পূজার ছুটি পড়ে গেলেই ঈশা স্টিমারে না হয় নৌকায় চলে আসবে।
তখনও নিরাময়দার বিনয়ের শেষ নাই।– আজ্ঞে কর্তা আমি কী পাগল। জল এখন নামছে। বিল খাল থেকে সব জল নদীতে নামছে। পোকামাকড় সব জলে ভেসে যাচ্ছে। মাছেরা গন্ধ পায়, ঢাইন মাছেরা ঝাঁকে ঝাঁকে উঠে আসছে। বড়ো বড়ো হা করে গিলছে সব। পাতালপুরীতে রাজসূয়যজ্ঞ শুরু হয়ে গেছে জানেন!
কাকা পুকুরে ডুব দিতে যাচ্ছেন। তাঁর সন্ধ্যা-আহ্নিক আছে, ঠাকুর পূজা আছে। কোথায় কোন যজমান বাড়িতে বিবাহ আছে। সকাল থেকেই তিনি ব্যস্ত। কাকিমা জেঠিমারা হেঁসেলে ব্যস্ত। ঠাকুমার ঘরে ঠাকুরমা পূজার বাসনকোসন বের করে দিচ্ছেন। সবাই নিজের কাজে ব্যস্ত—অথচ আমাদের স্কুল ছুটি, সারাটা দিন কী যে করি! নিরাময়দা ঢাইন শিকারে গেলে কথা দিয়েছিল আমাদের নিয়ে যাবেন। শুধু তাকে দু-কৌটা আরশোলা ধরে দিতে হবে। এখন তিনি কাকার কাছে কী ভালোমানুষ! মেজদা ক্ষোভে ফুঁসছে। বইখাতা ছুড়ে ফেলে একেবারে উঠোনে নেমে গেল। মেজদা যে গোয়ারগোবিন্দ বাড়ির সবাই জানে। নিরাময়দাও জানে।