দ্যাখ তো কে এল! বাবা তার দিকে তাকিয়ে কথাটা বললেন।
মা বলল, চেক দেব কিন্তু।
তা দিন। চেকই নিয়ে থাকি। অ্যাকাউন্ট পেয়ি চেক।
তাই দেবার নিয়ম। সে এবার বাক্স থেকে পরিশ্রুত জলের মেশিন এবং তার লটবহর টেনে বের করতে থাকল।
ও মা জেঠুমণি।
জেঠুমণি টুকতেই বাবা বেশ চঞ্চল হয়ে উঠল। কোথায় বসায়! ঘরে এ দিকের পাখাটা চলছে। ও দিকের পাখা চালিয়ে বলল, বড়োদা এখানটায় বসুন।
সঞ্চারী দেখল জেঠুমণি মেশিনের বাক্সটার দিকে তাকিয়ে চোখ ফেরালেন কুঁজো হয়ে বসে থাকা যুবকটির দিকে তারপর মা এবং বাবা, শেষে দেয়ালের ছবি, এবং ছাদের পাখাও বাদ দিল না।
বললেন, তোমারও দেখছি খপ্পরে পড়ে গেছ।
আসলে উক্তিটি বউমার প্রতি না বাবা, না তারা সবাই সঞ্চারী বুঝতে পারছে। জেঠুমণির এই কথাটাই যে সব কেঁচিয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। সঞ্চারী এটাও বোঝে। এবারে জেঠুমণি পাখার নীচে শশাফায় বসতে বসতে বললেন, কতদিনে পাকড়ালে হে ছোকড়া। ঠিক জায়গাতেই এসে গেছ।
না স্যার, পাকড়াব কেন। এটা তো ফ্যামিলির পক্ষে খুবই জরুরি।
বাজে কথা। বছর খানেক আগে আমার বাড়িতেও গছিয়ে দিয়ে গেছে। কোনো কাজ হয় না। সাধারণ ফিল্টারেই কাজ চলে। যাই বল এতে ভাইরাস কিছুতেই আটকায় না।
বাবাও গোঁ ধরলেন, আপনি ঠিকই বলেছেন, কিন্তু বাড়ির সবাই চাইছে, আমার তো একদম ইচ্ছে ছিল না।
সঞ্চারী এবার আর পারল না।
একদম মিছে কথা বলবে না বাবা। সবাই চাইছে মানে। আমি কখনো বলেছি কিনতে।
বলিসনি, তবে কেউ কিছু কিনলেই বাড়িতে এসে কে সাতকাহন করে বলে, বল।
আমি বলি না। তোমাদের পছন্দ হলে কিনবে, না হয় কিনবে না। আমাকে এর মধ্যে জড়াবে না বলে দিলাম।
জেঠুমণি বললেন, আরে রাগ করছিস কেন। সঞ্চারী দেখল, মা গুম হয়ে বসে আছে। একটা কথাও বলছে না।
জেঠুমণি কিছু একটা আঁচ করতে পেরে বললেন, কেনার যখন ইচ্ছে হয়েছে কিনে ফেল। কত টাকাই তো জলে যায়।
যুবকটি এতক্ষণ হাবলার মতো তাকিয়ে ছিল, এবারে সে বলল, দেখুন স্যার একটা কথা বলব, কিছু যদি মনে করেন। আমাদের মালে লাইফ লং সার্ভিস, আমার কোম্পানির মাল হলে ঠিকানা দেবেন, আমি নিজে মিস্ত্রি নিয়ে এসে ঠিক করে দেব।
ও সবাই বলে, কল দিলে পাত্তাই পাওয়া যায় না। ছ মাসও গেল না। বড়ো বড়ো কথা সবাই বলে—সকাল নটা থেকে শুরু—আসছে, যাচ্ছ। দরজায় বেল বাজছেই। কাঁহাতক দরজা খোলা যায়। আমরা স্যার বিজনেস ম্যানেজমেন্ট থেকে এসেছি, কী সাবান ব্যবহার করেন, কেন করেন, এই সবের ডাটা সংগ্রহে এসেছি। শেষে যা দাঁড়ায় ঝুলি থেকে বিড়াল, একটা শ্যাম্পেল মাল রাখুন, দাম দিতে হবে না। এই তো ভাই তোমাদের চেহারা। দুপুরে ঘুমাতে পর্যন্ত পারি না। বেচু পার্টিরা অতিষ্ঠ করে মারছে। এক তলায় থাকার এই একটা বিড়ম্বনা।
সঞ্চারীর খুবই খারাপ লাগছে। মা-র দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা কি কিনবে?
কেন কিনব না!
বাবা বললেন, সেই, কেন কিনব না। ভাইরাস থাকে থাকুক।
যুবকটি বলল, ব্যবহার না করলে বুঝতে পারবেন না, কত দরকারি জিনিস।
ভাইরাস মরে না কে বলেছে! কত উন্নতি হচ্ছে সবকিছুতে। ভিতরে আলট্রা ভায়োলেট রে দিয়ে ভাইরাস মেরে দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। বাজারের আর দশটা মালের সঙ্গে স্যার গুলিয়ে ফেলবেন না।
জেঠু বললেন, দ্যাখো ভাই আমি তো কিনছি না, কিনবে এঁরা।
সঞ্চারী দেখল, মা যেন কিছু বলতে চাইছে।
বলল না কী বলতে চাও।
লাইফ লং সারভিস বলছেন? যুবকটির দিকে মা তাকিয়ে থাকল।
হ্যাঁ মাসিমা।
কিন্তু কমপ্লেন আছে। আমার বন্ধুরা আপনার কোম্পানির মালের খুবই সুখ্যাতি করেছে। তবে একটাই মুশকিল, মাঝে মাঝেই খারাপ হয়ে যায়। কল দিলে কেউ তখন আসতে চায় না।
কল চার্জ দিলে আসবে না কেন মাসিমা? সঞ্চারী নিজেও কেমন অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে।
আমি উঠছি মা।
সঞ্চারীর কেন যে মনে হচ্ছে, যুবকটি বাড়িতে ঢুকে চোরের দায়ে ধরা পড়েছে যেন। সে বিরক্ত গলায় বলল, আপনার কী নাম!
অমিত সেন।
আপনারা কেন আসেন বুঝি না। কী দরকার আসার। কী দরকার এত খোশামোদ করার। দু-দিন ধরে ঘুরছেন।
যুবকটি অবলীলায় বলল, দরকারে দু-দিন কেন বছরের পর বছর ঘুরতে পারি। আমাদের এটাই তো কাজ।
তা হলে ঘুরুন। সঞ্চারী আর একটাও কথা বলল না। রাগে ফুঁসছে। সে ভিতরে ঢুকে গেল। তারপর যা হল, মা বাবাকে দুষছে। বাবা মাকে দুষছে। কার অ্যাকাউন্ট থেকে চেক কাটা হবে, সেটা এই মুহূর্তে দিলেও দু-দিন বাদে ব্যাংকে জমা দিতে হবে। তাতেও রাজি। বাবার কথা, এক সঙ্গে এত টাকা দেওয়া ঠিক না। বরং ইনস্টলমেন্টে কেনা ভালো।
ইনস্টলমেন্টে কিনলে লাইফ লং সার্ভিসের গ্যারান্টি দেওয়া যাবে না, যুবকটি ক্যাটালগ খুলে তাও দেখাল।
পরদার ফাঁক দিয়ে সঞ্চারী দেখতে পেল, যুবকটির মুখ ক্রমে ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে।
বাবার কথা, চেক দিলে, মেশিনটা রেখে যেতে হবে। এবং দেয়ালে জুড়ে দিতে হবে। তারপর ব্যাংকে চেক জমা যাবে। কে ঘুরবে ভাই তোমাদের পেছনে।
যুবকটি বলল, ঠিক আছে পরশু দেবেন চেক। পরশু আসব। বলে সে বেশ ভারী জিনিসটি হাতে ঝোলাতে গেলে, জেঠুমণি বলল, এটা রেখে যান। এতটা রাস্তা আবার টেনে নিয়ে যাবেন। কষ্ট হবে। বাসের যা অবস্থা।
না, নিয়ম নেই। পেমেন্ট এগেনস্ট ডেলিভারি। তারপর জেঠুমণির দিকে তাকিয়ে বলল, স্যার আমাদেরও বাবা-মা আছেন। আমাদেরও পুজো পার্বণ সবই আছে। ভাইবোনেরা দাদার আশায় থাকে। ফিরতে ফিরতে কত রাত হবে জানি। সল্ট লেকের ডিপোতে মাল জমা দিয়ে, কত রাতে কোন বাসে যাব তাও ঠিক জানি না। আমি না ফেরা পর্যন্ত বাড়ির সবাই জেগে থাকবে।