আলতার শিশি দেখে বলেছিলাম, ও দিয়ে কী হয়! হরিচরণবাবু কেমন কিছুটা ধরা পড়ে গেছেন, ভেবে বলেছিলেন, আমার ঠাকুমা বিধবা হলেও সধবার বেশে থাকতেন। মাছমাংস খেতেন, সিঁদুর পরতেন, আলতা পায়ে দিতেন। আমার দাদুই নাকি বলেছেন, আমি তো আছি। থান পরা দেখলে কষ্ট হয়—তুমি ওভাবে থাকবে না। হরিচরণবাবু আরও বলেছিলেন, শুধু এই আসনটার জন্য তিনি পৈতৃক সম্পত্তির সব ছেড়ে দিতে রাজি ছিলেন—কিছু নেনওনি। তবু তাঁর ছোটোকাকা বাড়ির ছেলে ফুটপাথে গিয়ে উঠবে ভেবে শেষের দিকের একতলায় এই পরিত্যক্ত ঘরটা ছেড়ে দিয়েছিলেন।
আমি কিন্তু আলতার শিশিটাই দেখছিলাম।
হরিচরণবাবু কী ভাবলেন, কে জানে। বললেন, আমি আসনটায় বসলে অনেক কিছু টের পাই। বিশ্বাস করুন, আমাদের ছাদের কার্নিশে শকুন উড়ে এসে বসবে আগেই টের পেয়েছিলাম। গেরস্তের বাড়িতে শকুন বসা খুব অশুভ ব্যাপার। সকালের দিকেই সেদিন ছাদে উঠে গেছিলাম, ঠিক দেখছি উড়ে আসছে। ভাইপো ভাইঝিদের নিয়ে সারাদিন ছাদে শকুন দুটোকে তাড়া করলাম। ওরা বসবেই—যেন এক খণ্ডযুদ্ধ বেধে গিয়েছিল আর কী!
বললাম, বসলে কী হত!
কারও অপমৃত্যু হত!
সেটা কে!
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেছিলেন, সম্ভবত আমি নিজেই। কথাটাতে কেমন গা শিরশির করে উঠেছিল।
হরিচরণবাবু বলেই চলেছেন, ঘোর অমাবস্যায় আসনটায় বসলে, ঠাকুমা ঠাকুরদা, যে-কোনো আত্মার সঙ্গে আমি কথা বলতে পারি। আপনি বিশ্বাস করবেন না, এক একজন এক এক ধাপে থাকে। অনেকের নামতে কষ্ট হয়। ঠাকুমাই দেখছি কেবল রাগ করেন না। আপনি বসবেন একদিন! নিয়মকানুন আছে, লাল পাড় গরদের শাড়ি পরতে হবে। পায়ে আলতা, কপালে সিঁদুরের টিপ—একেবারে একজন নারীর বেশে বসতে হবে। না হলে হবে না।
আলতা-রহস্য টের পেয়ে মুচকি হাসলে তিনি খুব গম্ভীর হয়ে গেছিলেন। বলেছিলেন, এদের নিয়ে তামাশা ঠিক নয় স্যার।
এমন একজন এ-বাড়িতে থাকে, ভাইপো-ভাইঝিরা পর্যন্ত কাছে আসে না, উন্মাদ নয় তো! কী জানি, এতটা বিশেষণের আমার কোনো প্রয়োজন ছিল না। পথিবীতে কত বিচিত্র লোক আছে—যে যার বিশ্বাস নিয়ে বড়ো হয়, বাঁচে তারপর একদিন মরেও যায়। হরিচরণবাবুর বিশ্বাসে আঘাত দিতে আমার ইচ্ছে হয়নি।
বছর দশেক হল ওঁর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে আমার। কারখানা সত্যি উঠে গেল। তিনি বেকার হলেন। আমিও। তবে সঙ্গে সঙ্গে একটা কাগজে চাকরি পেয়ে আমি থিতু হয়ে বসতে পেরেছিলাম। আমার বাড়িঘরও হয়েছে। দোতলা বাড়ি। কেষ্টপুর খালের ধারে আমার বাড়িটা। সকালে লিখতে বসেছি, দেখি হরিচরণবাবু হাজির। কেমন সামান্য কৃশকায়—লম্বা ছ-ফুট মানুষটা যেন কিছুটা অস্বস্তির মধ্যে পড়ে গেছেন। এসেই বললেন, স্যার এলাম। আপনার ছোটো ছেলে এবার ডাক্তারিতে ভরতি হয়েছে। ও একটা কঙ্কাল এনেছে। ওটা আমার দেখার শখ হয়েছে, তাই চলে এলাম, কিছু মনে করবেন না।
হরিচরণবাবুর এসব কথা জানবার নয়। বছর চারেক ধরে তাঁর সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। তবু এতটা খবর রাখায় আমি ভারি অবাক হয়ে গেছিলাম। হয়তো কৃতজ্ঞতাবশে তিনি আমার সব খবরই রাখতেন। আমি তাঁর কোনো খবর রাখার উৎসাহ বোধ করিনি।
নীচের ঘরে কথাবার্তা হচ্ছিল। জিজ্ঞেস করলাম—কী করছেন? কেমন আছেন? শরীরটা তো দেখছি বেশ ভেঙে গেছে। কতদিন পর দেখা!
বাড়ির কাজের মেয়েটি আমাদের জন্য চা রেখে গেল, কিছু খাবার।
হরিচরণবাবু বললেন, আমি এত সকালে কিছু খাই না। কঙ্কালটা দেখে চলে যাব। একটা বড়ো বেতের বাসকেটে কঙ্কালটা নিয়ে এসেছে।
তিনি এত খবর পান কী করে?
হরিচরণবাবু বললেন, দোতলার ঘরে ছেলের খাটের নীচে আছে।
হরিচরণবাবুর অদ্ভুত চরিত্র আমার জানা। অন্য যে-কারও মুখে এমন কথা শুনলে চোখ কপালে উঠে যেত, কিন্তু হরিচরণবাবু বলেই চোখ কপালে উঠল না। আসনটায় বসলে তিনি তো সবই টের পান। পরলোক রহস্য আমরা আর কতটা জানি। টেবিল টার্নিং-এর কথা তাঁর কাছেই প্রথম জানতে পারি। ওপার থেকে যাঁরা মাঝে মাঝে পৃথিবীতে নেমে আসেন, যেমন দানিকেনের বইগুলি আমার পড়া আছে—বিশ্বাসও করতে পারি না, আবার অবিশ্বাসও করতে পারি না। বললাম, চলুন দেখবেন।
ছোটো ছেলে বাড়িতেই ছিল। তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম। বললাম, উনি হরিচরণবাবু। তোমরা ওঁকে ছেলেবেলায় দেখেছ। আমার বাসায় মাঝে-মাঝে যেতেন। উনি তোমার কঙ্কালটা দেখতে চান।
ছেলে দেখাবে কী, তিনি নিজেই বাসকেটটা টেনে বের করলেন। হাড়গোড় সব মাটিতে ফেলে সাজাতে বসে গেলেন। আমার ছেলে হরিচরণবাবুর আচরণে কেমন ঘাবড়ে গেছে। সে তাঁকে শুধু দেখছিল।
করোটিটা হাতে নিয়ে দেখতে থাকলেন।
তারপর মেরুদণ্ডের আলগা হাড়গুলি—বুকের পাঁজরের হাড়। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার কখনো মনে হয় ঠিক এরকম একটা কুৎসিত কঙ্কাল আপনি বয়ে বেড়াচ্ছেন! আপনার ভেতরেই আছেন তিনি।
আমার কেমন জ্বর আসছে। মুখ মাথা গরম হয়ে গেল। সত্যি তো এটা আছে, অথচ বিশ্বাস করতে পারি না ছালচামড়া তুলে নিলে আমিও এই। খুবই নিষ্ঠুর সত্য।
হরিচরণবাবু অনেকক্ষণ ধরে অপলক দেখলেন কঙ্কালটা। তারপর বললেন, করোটির একটা হাড় কম।
ছেলেও দেখছি সায় দিল। বলল, হ্যাঁ। অকসিপিটালের পাশের দুটো হাড়ের একটা নেই, প্যারাইটাল একটা।