মাঝে মাঝেই তিনি বলতেন, স্যার যাবেন, চলুন না। আমি বলতাম, কোথায়? তিনি বলতেন, চলুন, দেখতে পাবেন, আপনি তো ভূতটুত বিশ্বাস করেন না। আমার বিশ্বাস, একটা রাত আমার সঙ্গে কাটালে বিশ্বাস হবেই।
আমি বলতাম, বিশ্বাস করি না কখন বললাম! বলেছি, আমি নিজে ভূত দেখিনি। ভূতটুতের বিষয়টা আসলে সংস্কার। যেমন ঈশ্বর আছেন—এটা একটা সংস্কার। মন্দির দেখলে মাথা যে ঠুকি—তা সংস্কার থেকেই।
হরিচরণবাবু বলতেন, না তেনারা আছেন। এবং এটা হত, যখনই হরিচরণবাবু আমার ঘরে ঢুকতেন, এ-কথায় সে-কথায় ভূতের প্রসঙ্গ টেনে আনতেন। বলতেন, দেখুন, আমার ঠাকুমার একটা পোষা ভূত ছিল।
পোষা ভূত শুনে চমকে গিয়েছিলাম!
বিশ্বাস করুন। আমাদের পরিবারের কোনটা শুভ অশুভ—সেই পোষা ভূতটা এসে ঠাকুমাকে সাবধান করে দিয়ে যেত।
কী জানি মশাই, এমন আজগুবি কথা আমি শুনিনি!
হরিচরণবাবু ততোধিক উৎসাহের সঙ্গে বলতেন, আমার দাদু, বুঝলেন না, তিনি ঠাকুমার পোষা হবেন না! অকালে মারা গেলেন—ঠাকুমা বাবা-কাকাদের বড়ো করেছেন, তাঁরই নির্দেশে। আমার পিসি এল বেড়াতে, ঠাকুমা দেখলাম হত্যা দিয়েছেন ঠাকুর মণ্ডপে। কী ব্যাপার! সারাদিন জলগ্রহণ করলেন না! সাঁঝবেলায় বললেন, নীহারকে আজ একটু বেশি মাছ মাংস খেতে দে। আমার বাবা শুনে অবাক। ঠাকুমার এককথা, নীহারের বর কালই মরে যাবে। তিনিই বলে গেছেন। পরে আমরা সব জেনেছিলাম।
তিনি মানে?
আমার দাদু, মানে ঠাকুমার পোষা ভুত। আমার বাবা যে ডাকসাইটে ফুটবলার হবেন, ঠাকুমা আগেই জানতেন। বলতেন, ও পড়াশোনা করছে না তো কী হয়েছে। যা করতে চায় করতে দাও। খেলার দৌলতে বাবা ইস্টার্ন রেলের বড় চাকরি পেয়ে গেলেন।
সুতরাং যাদের বাড়িতে পোষা ভূত থাকে তারা ভূতে বিশ্বাসী হবে বিচিত্র কী। হরিচরণবাবুও নাকি ঘোর অমাবস্যায় ঠাকুমার আসনে বসলে টের পান, পোষা ভূতটি বাড়ি ছেড়ে যায়নি। তাঁর যে চাকরি হবে আমার সঙ্গে দেখা করলে, এটাও নাকি তাঁর ঠাকুরদারই নির্দেশ।
আমাকে শুনতেই হত। কারণ অবিশ্বাসের কথা বললে, নানারকমের যুক্তি, আচ্ছা আপনি, পড়েছেন! বলে একজন ভূত বিশেষজ্ঞের বইয়ের এমন সব কাহিনি উল্লেখ করতেন যে, আমি খুবই বিস্মিত হতাম।
যেমন, একবার হরিচরণবাবু বলেছিলেন, একটা ছবি দেখাব।
ছবি!
হ্যাঁ। দেখবেন ছবিটা। দেখলেই বুঝতে পারবেন! বলে তিনি সত্যি একটা ছবি একদিন এনে আমাকে দেখালেন। একজন বিধবা মহিলা, আর তার পাশে তিন ছেলে দুই মেয়ে। পেছনে আরও একজন কেউ দাঁড়িয়ে আছেন, ছায়ার মতো—খুব স্পষ্ট নয়।
তিনি ছবিটা দিয়ে বললেন, আগে ভালো করে দেখুন।
বললাম, দেখছি।
ভালো করে দেখুন।
বলছি তো ভালো করে দেখেছি।
তিনি এবারে উঠে এসে আমার পাশে দাঁড়ালেন। এই যে দেখছেন, পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন, তিনি ভদ্রমহিলার স্বামী।
ভদ্রমহিলাটি কে?
আমার সেই পিসি!
অঃ।
আমার পিসেমশাইয়ের মৃত্যুর তিন মাস পরে তোলা। ছবিটাতে দেখা যাচ্ছে, আমার পিসেমশাইও আছেন। মৃত্যুর পরও মানুষ তার আত্মীয়স্বজন ছেড়ে যে যেতে চায় না, এটা তার জ্বলন্ত প্রমাণ। আপনার এখনো বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় ভূত নেই! ভূতটুত আসলে সংস্কার, ঈশ্বর আসলে সংস্কার এ রকম ভাববেন না।
সেদিন আমি বলেছিলাম, এটা যে আপনার পিসেমশাই জানলেন কী করে!
জানব না! তাঁকে আমি চিনব না!
ছবিটা স্পষ্ট নয়। আপনার পিসিমা কী বলেন!
পিসি কী বলবেন! মরে যাবার পরও মানুষটা ঘরবাড়িতে ঘুরে বেড়ায়, এমনকী ছবি তোলার সময় পর্যন্ত তিনি স্থির থাকতে পারেননি, শত হলেও স্ত্রী-পুত্র-কন্যার পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে কার না শখ হয়। শখের জন্যই শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ে গেলেন। পিসিমা তো ছবিটা দেখার পর বাড়িতে রক্ষাকালীর পূজা, চণ্ডীপাঠ সব করালেন। গয়াতে গিয়ে প্রেতশিলায় পিণ্ডদান করালেন। তারপর আবার ছবি তুললেন সবাইকে নিয়ে। দেখা গেল, না আর পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে নেই। কেউ দাঁড়িয়ে থাকত না।
সেই যা হোক, হরিচরণবাবুর সঙ্গে এক কারখানায় আমার আর বেশিদিন কাজ করা হল না। শ্রমিকদের দাবিদাওয়া বাড়তে থাকল, অথচ প্রোডাকশন বাড়ল না— বেশি প্রোডাকশনের দাবিতে চুক্তি হয়। পরের বছর চুক্তি ফেল করে। ওভারটাইম নেবে, অথচ কাজের সময় কাজ করবে না। হরিচরণবাবু বলতেন, এও এক রকমের ভূত স্যার। মাথায় ভূত না চাপলে, কাজ করব না, পয়সা নেব ঠিক কখনো হয়! সবই হলোগে সেই ভূত রহস্য। হরিচরণবাবু সবটাতেই অদৃশ্য এক ভূতের হাত দেখতে পেতেন! আমার হাসি পেত। একদিন নাছোড়বান্দা হয়ে আমাকে তাঁর বাড়ি নিয়ে গেলেন। পৈতৃক সম্পত্তির একখানা ঘর ভাগে জুটেছে। শোভাবাজারের এক এঁদো গলির মধ্যে দোতলা বাড়ি। বাড়ির শেষ কোণের ঘরটায় তিনি থাকেন। কাকা জ্যাঠাদের সঙ্গে খুব ভালো একটা সম্পর্ক আছে মনে হয় না। আলো না জ্বাললে ঘরের কিছু দেখা যায় না। একটা ঘুলঘুলি দিয়ে সামান্য আলো আসে। প্রায় পা টিপে টিপে তাঁর ঘরের দিকে এগোলাম। দিনের বেলাতেও কেমন গা ছমছম করে। বাড়ির লোকজন এদিকটায় বড়ো একটা আসেন না, এটাও টের পেলাম। ঘরের দেয়ালে সেই পিসির গ্রুপ ছবি। তাতে সিঁদুর দেওয়া নীচে তক্তপোশ, মাদুর, ময়লা তোষক বালিশ। একটা হরিণের ছাল। এটাতে বসেই হরিচরণবাবুর ঠাকুমা তাঁর দাদুর সঙ্গে কথা বলতেন। তক্তপোশের নীচে অজস্র শিশি বোতল, পেতলের বাটি, আলতার শিশি।