কখন বলল?
যখন কুকুরটাকে নিয়ে কলপাড়ে দাঁড়িয়ে ছিলে।
আরও বিমর্ষ হয়ে গেল তালেব।
তারপর ইনিয়ে বিনিয়ে বলল, আমি চলে যাব নদীর পাড়ে বাড়ি করে। এখানে কিছুতেই থাকব না। বলে যদি থাকি, সেভাবে কথাটা বলিনি, জলে কখনও কি স্বর্ণমুকুট ভাসে!
প্রিয়তোষ বললেন, ভাসে না প্রতিবিম্ব সৃষ্টি হয়।
সে যাই হোক, কথাটা যদি বলেই থাকি, তবে আপনার বাড়িঘরের কথা ভেবেই বলেছি। সবারই চাই স্বর্ণমুকুট। এই ঘরবাড়ি সংসার মানুষের যে সেই স্বর্ণমুকুট লাভের আশায়। জমি কিনলেন, খোকাবাবু বড়ো হতে হতে শহরের ধস এদিকটাতেও নেমে আসবে। পাঁচ কাঠা জমি সোজা কথা! কী অমূল্য দাম হবে তখন। সেই ভেবেই কথাটা বলা।
ঠিক আছে, তোমার কাছে স্বর্ণমুকুট নেই। এখন পানুর একপাশে বসে যাও। তোমাদের খেতে দিয়ে আমি খেতে বসে যাব। সকাল হলে পানুকে নিয়ে একবার জঙ্গলটা ঘুরে আসবে। ছেলেমানুষ যত্তসব আজগুবি চিন্তার ডিপো। সব ঘুরিয়ে দেখালে জঙ্গল নিয়ে আর কোনো রহস্য থাকবে না। বাড়িতে তোমার বউদিকে যা জ্বালায়!
তারপর প্রিয়তোষও খেতে বসে গেল। খাওয়া হলে বাড়তি ডাল-ভাত কুকুরটাকে দিয়ে সে ঘরে ঢুকে গেল। তালেব বাসনকোসন ধুয়ে সব এঁটো সাফসোফ করে বারান্দার সামনে কাঁথা গায়ে শুয়ে পড়ল। শুয়ে পড়ল ঠিক, তবে তার ঘুম এল না। খোকাবাবু ঠিক টের পেয়ে গেছে, সে ভালোমানুষ না। তার চুরি চামারির স্বভাব ছিল, না হলে নক্ষত্র চুরি করার কথা উঠত না। তারপর কেন যে ভাবল সে যা খুঁজে পাচ্ছে না, খোকাবাবু তা ঠিক খুঁজে বের করতে পারবে। টিনটিনের বন্ধু। নিখোঁজ জিনিসের উদ্ধারে খোকাবাবু তাকে সাহায্য করতে পারে। সে তো আর লোভে পড়ে নেই, তার মনেও থাকে না। এই কাশের জঙ্গলে সে তার চুরি করা ধনসম্পত্তি সব মাটির নীচে পুঁতে রেখেছিল। খোকাবাবু আসায় আবার তার সব মনে পড়ে গেছে। সেখানে দিঘাপতিয়ার রাজার মুকুটটিও যে আছে, শতবার বললেও কেউ বিশ্বাস করবে না।
সকালে উঠে চিড়ে মুড়ি দিয়ে পানুর আহারপর্ব ভালোই হল বলা চলে। বাবা খালপাড়ে যাবে, নৌকোয় যদি শ্যামলাল থাকে, এবং তারা যাবে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে। পানু তার এয়ারগানটা নিতে ভুলল না। কিছু ঘুঘু পাখি উড়ে যাচ্ছিল, কিছু শালিখ পাখি, খালপাড়ে উঠে পানু দেখল, তালেবকাকা কাশবনের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে।
সে ডাকল, তালেবকাকা কী দেখছ?
তালেব কেমন উদাসীন গলায় বলল, একখানা কথা আছে আমার।
কী কথা!
আপনি টিনটিন, সব রহস্যভেদের ওস্তাদ। ওই যে কাশের জঙ্গল দেখছেন, তার ভেতর মেলা ধনসম্পত্তি লুকনো আছে। লোকটা খুবই আহাম্মক, পুলিশের তাড়া খেয়ে এদিকটায় এসে থমকে গেল। সে ভাবল, এমন নির্জন জায়গায়, তার ধনসম্পত্তি লুকিয়ে রাখলে কেউ টের পাবে না। যেই না ভাবা, সঙ্গে সঙ্গে কাজ শুরু। তখন উরটি মাঠ। বৈশাখ মাস, লু বইছে, গোপনে মাথাসমান মাটি খুঁড়ে সে তার ধনসম্পত্তি সব লুকিয়ে ফেলল। ত্রাসে পড়ে গেলে মানুষের যে মাথাও ঠিক থাকে না খোকাবাবু।
পানু হাঁ করে সব শুনছে।
তারপর।
তারপর লোকটা ক-বছর বিবাগী হয়ে থাকল। ওই যে নাম, ঠিক হয়ত পুলিশ টের পেয়ে গেছে, সে এদিকটায় এলেই তাকে ধরে ফেলবে, এইসব ভেবেই লোকটা চার বছর তিন মাস কুড়ি দিন বাদে যখন এল, দেখল শুধু কাশের জঙ্গল। যতদূর চোখ যায় শুধু কাশফুল। কোথায় তার লুকানো ধনসম্পত্তি টেরই পেল না। কাশের জঙ্গলে জায়গাটা ভারি মনোরম হয়ে আছে।
তারপর?
তারপর লোকটা শ্রীপদ বাগুইয়ের কাছ থেকে জমি কিনে বসবাস শুরু করে দিল। দিনে লণ্ঠন ফিরি করতে বের হয়, রাতে কোদাল কাঁধে জঙ্গল কোপায়। ওই কোপানোই সার। এভাবে মাস যায়, বছর যায়, শেষে তার কেন যে একদিন মনে হল, জঙ্গলেরও সৌন্দর্য আছে। সে কোদাল কুপিয়ে তাও বিনষ্ট করে দিচ্ছে। ওপরওলার কাছে সে কী জবাব দেবে! সেই থেকে এই মাঠ, শীতলকুচির মাঠ ঠান্ডা মেরে আছে। তার আর রূপ বদলায় না। সেই থেকে সে শুধু ভাবে, নদীর পাড়ে বাড়ি করে সে চলে যাবে। বলে লণ্ঠনওলা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
সব শুনে পানুর কেন যে মনে হল, লণ্ঠনওলা বড়ই দীর্ঘকায় মানুষ। তাকে সে আর ছুঁতে পারবে না—ক্রমে উঁচু লম্বা হতে হতে আকাশের দিকে তার মাথা উঠে যাচ্ছে। পানু শুধু তার বাবার মতোই বলল, তুমি আমাদের ফেলে চলে যেও না। নদীর পাড়ে বাড়ি আর তোমার নাই বা হল। নদীর জলে স্বর্ণমুকুটের প্রতিবিম্ব দেখার জন্য চলে গেলে আমরা যে খুব একা হয়ে যাব কাকা।
হরিচরণবাবু
ঈশ্বর যখন আছেন, তখন ভূতও থাকবেন। হরিচরণবাবু আমাকে এমন বলতেন। আমরা একসঙ্গে তখন একটা কারখানায় কাজ করি। হরিচরণবাবুকে কারখানায় আমি কাজ দিয়েছিলাম। মাথায় টাক, বয়স হয়েছে, বেকার ছিলেন, বাবা ডাকসাইটে ফুটবলার ছিলেন এবং বলতে গেলে আমার কাছে চাকরির উমেদারিতে যখন দেখা করতে আসেন, তখন ওঁর বাবার নাম শুনে চাকরিটা না দিয়ে পারিনি। এত বড়ো ফুটবলার, বলতে গেলে কিংবদন্তী, এমন মানুষের একজন পুত্র বেকার থাকবে ভাবতে কষ্ট হয়েছিল। প্রথমে ভাউচার লিখতেন, কারখানার বিল আদায় করতেন, পরে কারখানার প্রোডাকশনের দিকটা সামলাতেন।
হরিচরণবাবু বিয়ে থা করেননি। বয়স পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ—এই বয়সে প্রথম তাঁর চাকরি, তা ছাড়া আমাদের কারখানার অবস্থাও বিশেষ ভালো না, আজ ওঠে তো, কাল উঠে যায়—এহেন পরিস্থিতিতে তাঁর বিয়ে করা চলে না—এমন বলতেন। পাওয়া ছুটিছাটা নেবার কোনো আগ্রহ তাঁর ছিল না। কেবল অমাবস্যা এবং বিশেষ বিশেষ শনিবার বাদে।