প্রিয়তোষ জঙ্গলে আঙুল তুলে বলল, আমরা এসে গেছি।
আসলে তালেব খোকাবাবুর সব কথাতেই সায় দিয়ে যাচ্ছিল। থাকুক না থাকুক, খোকাবাবু খুশি হলেই সে খুশি। কিন্তু টিনটিন সম্পর্কে সে কিছুই জানে না। টিনটিন বাস না উড়োজাহাজ, টিনটিন বিষয়টি বড়ই গোলমালে ফেলে দিয়েছে তাকে। যে নক্ষত্র চুরি করতে সাহস পায়, মাথায় যার স্বর্ণমুকুট থাকে, সে বলেই বা কী করে, এত খবর রাখি খোকাবাবু, তোমার টিনটিন বিষয়টি আদৌ বুদ্ধিগ্রাহ্য হচ্ছে না আমার! এখন কথা বললেই সে খোকাবাবুর কাছে একেবারে বুন্ধু বনে যাবে। সে শুধু বলল, সকাল হলে আমরা খুঁজে দেখব টিনটিন কোথায় আছে।
এতে পানু বড়োই আহ্লাদ বোধ করল।
জঙ্গলের ভেতর দিয়ে একফালি রাস্তা। পাশাপাশি দু-জনে হাঁটা যায় না। ঝোপজঙ্গলের লতাপাতা গায়ে লাগছে পানুর। সে বাবার প্রায় গা ঘেঁষে হাঁটবার চেষ্টা করছে। এত অন্ধকার চারপাশে যে, লোডশেডিং না হলে এমন অভিজ্ঞতা হওয়াও কঠিন। পানু দেখল, সামনে উঠোন, কুঁড়েঘরের বারান্দাও দেখতে পেল। একপাশে বাঁশের মাচান, মাচানে ব্যাগ, ব্যাগের ভেতর ঝালাইয়ের যন্ত্রপাতি, কাটা টিনের পাত দলাপাকানো। কাঠের তিন-চার রকমের হাতুড়ি। সে বারান্দায় উঠে যাওয়ার সময় সহসা কী এক আর্তনাদে চমকে গেল।
প্রিয়তোষ বললেন, ডাহুক পাখিরা ডাকছে।
কেমন এক কলরব, পাশে একটা জলা আছে, জলাজঙ্গলে ডাহুক পাখিরা ডাকে, এবং পানু আসায় ওরা যে আহ্লাদে আটখানা, প্রিয়তোষ তাও জানিয়ে দিলেন। ডাহুকেরা একসঙ্গে ডেকে উঠলে আর্তনাদের মতো শোনায়, তাও বুঝিয়ে বললেন প্রিয়তোষ। পানু কিছুটা নিজের মধ্যে ফিরে আসায় ঝিঝি পোকা ও কীটপতঙ্গের আওয়াজ শুনতে পেল।
আর তখনই একটা কুপি ধরিয়ে তালেব বাইরে রেখে দিল। দুটো পাথর, পাশে এক বালতি জল, পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে প্রিয়তোষ হাতমুখ ধুলেন, পানুকে হাতমুখ ধুয়ে নিতে বললেন। রাতে বেশ ঠান্ডা পড়ে। পানুকে জামা-প্যান্ট সোয়েটার বের করে দিয়ে বললেন, ধুলো ময়লায় সব নোংরা হয়ে গেছে, সব পালটে নাও।
তালেব এখন আর একটা কথাও বলছে না। তার যে মেলা কাজ। কাঠকুটো ধরিয়ে চা আর চিড়েভাজা কাঠের সরাতে সাজিয়ে দিল। প্রিয়তোষ গামছায় মুখ মুছতে মুছতে বলল, শ্যামলাল আর এসেছিল?
তালেব বলল, জি, শ্যামলাল মিস্ত্রির সঙ্গে দেখা হয়েছে। সে তো আপনার বাড়ি যাবে বলেছে। ইট বালি নৌকোয় খালে-খালে নিয়ে আসবে বলল, কত ইট ফেলবে, তা তো বলে যাননি।
শোনো তালেব, এই একটা থাকার ঘর, কিচেন আর একটা বাথরুম—এই হলেই চলবে। তবে সব একসঙ্গে করার ক্ষমতা আমার নেই। শেষ পর্যন্ত কী হবে তাও বলতে পারব না। একটা স্বপ্ন বুঝলে, নিজের ঘরবাড়ি, তবে বাড়িটা শেষ পর্যন্ত যে ভণ্ডুলমামার বাড়ি হয়ে যাবে না, তাও বলতে পারব না। একদিকে তুলব, আর একদিকে পড়ে যাবে। হাতে এত টাকা কোথায়! মাঠ ভেঙে সরকারি টিউকল থেকে জল আনারও অনেক হ্যাপা। তুমি না থাকলে কে করবে সব! এ-জীবনে আর তোমার নদীর পাড়ে বাড়ি নাই বা হল।
পানুর এসব বিষয়ী কথাবার্তা একদন পছন্দ না। সে ঘরের ভেতর মাটির মেঝেতে মাদুরে বসে চিড়েভাজা আর রসগোল্লা খাচ্ছে। টিফিন ক্যারিয়ারে মা আসার সময় ভরে দিয়েছেন।
ঘরে সেই জাদুর লণ্ঠনটা জ্বলছে। বাবা জলচৌকিতে বসে আছেন তার। দারান্দায় উনুনে মুগের ডাল ভাজা হচ্ছে। মুগের ডাল, বেগুনভাজা, আর গরম ভাত—পানুর যে খুব খিধে পেয়েছিল, তার খাওয়া দেখেই বোঝা যাচ্ছিল।
তালেব কাজও করছে, কথাও বলছে, বাবা এটা-ওটা এগিয়ে দিচ্ছেন, যেন কতকালের এই সখ্য।
তালেব বলল, এবারে জল ঢেলে দিন। প্রিয়তোষ উঠে কড়াইয়ে জল ঢেলে দিতেই ছ্যাঁক করে উঠল। প্রিয়তোষ ডাল, বেগুনভাজা নামিয়ে রাখলে তালেব বলল, বড়ো ধন্দে পড়ে গেলাম কর্তাঠাকুর।
তোমার আবার কিসের ধন্দ।
ওই যে খোকাবাবু বলল, তিনতিন না টিনটিন-ওটা খায় না ওড়ে, ঠিক বুঝতে পারছি না।
প্রিয়তোষ হেসে ফেললেন, আরও ওসব হচ্ছে ছবিতে গোয়েন্দা সিরিজ। মাথায় টাক যখন আছে দাড়ি থাকলে জাহাজের কাপ্তান হয়ে যেতে পারতে। টিনটিন খোকাবাবুর মতো একটা বাচ্চা ছেলে। তোমার মতো বয়সের একজন বন্ধু আছে তার। টিনটিনের কাছে কোনো অপরাধীরই ক্ষমা নেই। টিনটিন চোর ধরে বেড়ায়। পানু ছবির গল্প পড়তে পড়তে ভাবে সে নিজেই টিনটিন।
টাকমাথা, উসকোখুসকো একগাল দাড়ি নিয়ে তালেব কিছুক্ষণ বসে ছিল। টিনটিন চোর ধরে বেড়ায়, কথাটাতে সে খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছে। সে যে চুরিচামারি করত, তাও ধরে ফেলতে পারে। এই জঙ্গলের মাটির নীচে সে সব পুঁতে রেখেছে। জেল-হাজতও সে খেটেছে। জেল থেকে সে পালিয়ে এই জঙ্গলের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছিল। সামনের একটা জলায় ডুব দিয়ে আসার সময় এসব মনে হচ্ছিল তার। স্বর্ণমুকুটের কথাও জেনে গেছে মনে হয়। তারপর মনে হল তার, সে নিজের ঘোরেই এসব ভাবছে। কথাটা যাচাই করে দেখলে হয়!
তালেব বলল, কর্তাঠাকুর, স্বর্ণমুকুটের কথা কী যেন একখানা বললেন?
প্রিয়তোষ একেবারে হাঁ।
আমি বললাম, না তুমি বললে!
আমি আবার কবে বললাম?
তুমি একদিন বললে না, নদীর পাড়ে চলে যাবে। নদীর জল কলকল ছলছল, নদীতে স্বর্ণমুকুট ভাসে।
আমি একথা বলিনি।
না বললে পানু বলল কেন, দেখছ তালেব সোনার মুকুট পরে যাচ্ছে।