বাবাও ঢুকে বললেন, ও এসে গেছেন, বসুন।
তারপর পরদা তুলে ডাইনিং স্পেসে হাতের ব্যাগটা টেবিলে রেখে দিলে মা বলল, চা দেব! হাত মুখ ধুয়ে নাও।
আচ্ছা এরা কী! লোকটার সঙ্গে কেউ আর কথা বলছে না। নেওয়া হবে কি না তাও বোধহয় ঠিক নেই। সঞ্চারী খুবই অস্বস্তি বোধ করছে।
মা বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, কথা বলো।
তুমি বলো না।
কত দাম বলছে!
ওতো বাজার দর—কত বলার কী আছে। সাতে পাঁচ হাজার।
লোকটিকে এক কাপ চাও দেওয়া যায়। অন্তত বসার ঘরে চুপচাপ বসে না থেকে চা খেতে পারে। তার নিজেরই গায়ে কেমন জ্বালা ধরে যাচ্ছে। ভিতরে বসে তারা চা জলখাবার খাচ্ছে, লোকটিকে বসিয়ে রাখার কোনো মানেই হয় না।
সে না বলে পারল না, তোমরা ওর সঙ্গে কথা বলে ঠিক করে নাও। কতক্ষণ বসে।
থাকবে।
বলছি, দাঁড়া। একটু জিরোতে দে। বলেই বাবা ঘর থেকে পরদা তুলে বললেন, এই যে ভাই, বড়ো সকাল সকাল এসে গেছেন। মণিদি তো জানে আমার ফিরতে রাত হয়। ছুটির দিনে আসতে পারতেন। একটু দেরি হবে। আমরা ফ্রেশ হয়ে আসছি। কোথায় থাকেন?
হাওড়ায়। ওরে বাব্বা, সে তো অনেক দূর।
আজ্ঞে, তবে অসুবিধা হবে না। ও নিয়ে ভাববেন না। পরদার ফাঁক দিয়ে সঞ্চারীও দেখল, কেমন কুঁজো হয়ে বসে আছে লোকটি। লোকটি না ভেবে যুবক ভাবা যেতে পারে। তারই বয়সী, কিংবা কিছু বড়ো হতে পারে, সরু গোঁফ, কালো, বেশ কালো রঙের মুখে এত কালো গোঁফ মানায় না। বড় বেমানান। সে কেন যে ফিক করে হেসে দিল।
বাবার সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলছে, এবং কথাবার্তায় বড়োই বিগলিত ভাব। সেলসম্যানশিপ। ব্যবহারে যদি ভজে না যায়, তবে কপালে দুঃখ থাকতে পারে। একটু বেশি মাত্রাতেই আজ্ঞে আমি করছে। ভদ্রলোকের কপালে আজ বেশ দুঃখ আছে। তার বাবাটিকে তো জানে না। সব কিছু বাজিয়ে নেবার স্বভাব। এত বৈষয়িক যে জীবনেও ঠকতে রাজি না।
বাবা পরদা ফেলে দিলে, কালো মানুষ, কালো গোঁফ নিমেষে অদৃশ্য।
সঞ্চারীর কেন জানি চা খেতে ভালো লাগছে না। সে চা ঠেলে দিয়ে উঠে। পড়ল। খাবার কিছুটা খেল, কিছুটা পড়ে থাকল।
বাবা বললেন, কী হল, উঠে পড়লি।
তোমরা খাও। আমার খেতে ভালো লাগছে না।
শরীর খারাপ!
না।
জানি না।
সঞ্চারী চায়ের কাপ বেসিনে রেখে নিজের ঘরে ঢুকে গেল। কেমন অভব্য মনে হচ্ছে। সব ঠিকঠাক থাকলে বোধহয় এমন হয়। অন্যের মান অপমান বুঝতে চায় না। দুদিন ধরে ঘুরছে, সে জিনিস গছাতে এসেছে, এটাই তার কাজ।
হাওড়ায় বাড়ি, বাসে কী ভিড় সে নিজেই টের পায়। না এটা ঠিক না। মা কার, কার পূজার বাজার এখনও বাকি, বাবাকে সেই ফিরিস্তি দিচ্ছে। বাবা মার এমন আচরণ সে পছন্দ করে না। এত চেষ্টা করছে, একটা তার চাকরি হল না! সে বেকার। এই জ্বালা থেকেই বোধহয় ভদ্রলোকের ওপর সে একটু বেশিমাত্রায় সহৃদয় হয়ে পড়ছে।
এটাই তার দোষ।
বেকার না থাকলে, খোঁড়া কুকুরটার জন্য বোধহয় এত মায়া হত না। জীবকুলের সর্বত্রই ছড়ানো-ছিটানো হেয়জ্ঞান বিরাজ করছে। তাদের এই বয়সটাকে কেউ বুঝতেই চায় না। মেয়ে যখন, বিয়ে দিলেই রেহাই। বিয়ে, তারপর এক পুরুষ এবং পুরুষের বিছানা, তার জাতকের জন্য প্রস্তুত থাকা, তাকে বড়ো করা, মেয়েমানুষের আবার কী চাই। জানালার পরদা ঠিক আছে কি না, সতর্ক থাকলেই হল।
মানছি না, মানব না। সে কেমন স্লোগান দিতে যাচ্ছিল। তোমাদের টাকা, তোমাদের বাড়ি, আমি কেন অনুগ্রহ নিতে যাব। তারপরই মনে হল, না মাথাটাই তার খারাপ হয়ে যাচ্ছে। তার আজকের প্র্যাক্টিস টিচিংও ভালো হয়নি। বি টিতেও সেকেন্ড ক্লাস। স্যারেদের উমেদারি সে একদম করতে পারে না। সবাইকে চতুর এবং সুযোগসন্ধানী মনে হয়।
তখনই সবার ঘর থেকে বাবা ডাকলেন, সঞ্চারী শুনে যা। জিনিসটা একবার দেখবি না। তোরই পাল্লায় পড়ে কিনছি। তোর বন্ধুদের বাড়িতে অনেকের আছে, আমাদের থাকবে না, হয় কী করে। তোর মাও চাইছেন, তাঁর বন্ধুদের বাড়িতেও অনেকের নাকি আছে। জল এখন পরিত না করে খাওয়া ঠিক না।
পরিশ্রুত কথাটাতে সঞ্চারীর মুখ বেঁকে গেল। পরিশ্রুত না ফুটানি, সবার আছে। সবার আছে বলতে কারা! সবার কখাটা কত ব্যাপক বুঝবে না। সবার থাকে না, কিছু লোকের থাকে। বাবা-মা সেই কিছু লোকের মধ্যে। তাকে ডাকছে।
সে বলল, আমার আবার দেখার কী আছে! তোমরা কিনবে, তোমাদের পছন্দ হলেই হল।
বারে, একবারই তো কেনা হবে। দেখে নিবি না।
তোমরা দ্যাখো।
তখনই দরজায় মা পরদা ফাঁক করে বলল, আয় না। লোকটা কতক্ষণ বসে থাকবে।
সঞ্চারী এর পর আর নিজের ঘরে বসে থাকতে পারল না। তার পছন্দ না হলে সে কিনবে না, এমনও কথা নেই। তবে এই নিয়ে জল ঘোলা হোক সে চায় না। তার জন্য লোকটার দেরি হোক সে চায় না।
বাবার গলা পাওয়া গেল।
এত দেরি কেন রে।
সে শাড়ি পরছে। এবং মুখ আয়নায় দেখছে। পাফে সামান্য পাউডার মুখে ঘসে দিল। চুল দু-একটা এলোমেলো হয়ে কপালে উড়ছে। সে বের হয়ে বেশ পরিপাটি করে লোকটার পাশে না বসে বাবার পাশে গিয়ে বসে পড়ল।
সঙ্গে সঙ্গে যুবকের মুখ প্রত্যাশায় গাঢ় হয়ে গেল। সঞ্চারীর নজর এড়াল না। বড়ো সবিনয়ে বাক্স খুলতে গেলে সঞ্চারী বলল, খুলতে হবে না। ও আর দেখার কী আছে। আপনাদের কোম্পানির খুবই সুনাম।
আবার ডোর বেল।