জতু দেখছে, আবার থুতু ফেলছে কমল।
সে ডাকে, কমলবউ।
আমাকে কিছু বলবি।
কমলবউ তুমি এত থুতু ছিটাও কেন?
কমলবউ বলল, শরীর। শরীর কী আগে বুঝতে শেখ। শরীরে যে বিষ আছে। জতু দেখেছে, কমলবউ সারাক্ষণ থুতু ফেলে। উঠোনে দাঁড়িয়ে ছিত করে থুতু ফেলার অভ্যাস। হাঁটার সময়ও। মুখে এত থুতু জমে কী করে। সকালে পুকুরে ডুব দিতে যাবার আগে এটা তার হয়। জতু কিছুটা বোকার মতো তাকিয়ে থাকে কমলের দিকে। শরীরে এত বিষ, কেন হয়, বিষের কি মা বাপ নেই, কিংবা ঘৃণা কখনও মানুষের মধ্যে জেগে গেলে থুতু জমে উঠতে পারে মুখে। জতু অবশ্য থুতু মাড়িয়ে হাঁটে না। হাঁটার নিয়ম নেই। কমল ঠিক মনে রাখতে পারে কোথায় কখন সে থুতু ছড়িয়েছে। পুকুর থেকে পবিত্র হয়ে ফেরার সময় ঘটির জল ছিটিয়ে বসুন্ধরাকেও পবিত্র করে নেয়। সে দেখেছে, ঠিক যেখানে কমল আসার রাস্তায় থুতু ছিটিয়েছে—ঠিক সেসব জায়গায় জল ছিটিয়ে চলে যাচ্ছে। থুতুতে পা পড়ে গেলে কমল বোঝে। এই এত আতঙ্ক থেকে জতু, কমল যে রাস্তায় হাঁটে, তার থেকে কিছুটা আলগা হয়ে হাঁটে।
মা একদিন জতুকে কেন যে বলেছিল, তোমার এখানে কী? যাও।
কমলবউ বসে আছে মেঝেতে। ঠাকুমা মা জ্যেঠিমা সবাই ঘাটে বসে আছেন। কমলবউ পিঠের শাড়ি সরিয়ে ওঁদের কী দেখাচ্ছিল।
সে ঘর থেকে বের হয়ে গেছিল ঠিক, তবে কাছাকাছি এবং জানলার পাশে দাঁড়িয়েছিল।
আমাকে মারে।
ঠাকুমা বললেন, মারবে না, সোহাগ করবে। তুই কম যাস না। পুরুষমানুষ সারাদিন খাটাখাটনি করে, তার আর আছেটা কী! গোয়ার্তুমি করলে চলে।
আমার যে ইচ্ছে করে না ঠাইনদি।
মেয়েমানুষের আবার ইচ্ছে কী! তোর মুখে খেতা পুড়ি।
মা বলেছিলেন, তাই বলে মারধর করবে!
করবে না। মাথা না পাতলে সে বেচারাই বা যায় কোথায়?
জতুর কষ্ট সেই থেকে। যতীন দাদা মানুষ তো খারাপ না। তবে বেঁটে, বেঢপ, দেখতে আবলুস কাঠের মতো রং। চোখ দুটো চামড়ার ভাঁজে দেখা যায় কী যায় না। ব্যাঙের মতো নাকটা সায়া মুখ জুড়ে বসে আছে। কানে বড়ো বড়ো লোম, নাকের ভিতরে থেকে লম্বা গোঁফ এবং বিসদৃশ্য এই চেহারা কমলবউয়ের খারাপ লাগতেই পারে।
শেষে জ্যাঠামশায়ের কানেও কথাটা উঠেছিল।
সেদিন জ্যাঠামশাই সবে রোগীর বাড়ি থেকে ফিরে এসেছেন। জনার্দন কাকা তাঁর ঘোড়া নিয়ে আস্তাবলে বেঁধে দিচ্ছে। তিনি স্নানটান সেরে বৈঠখখানায় বসে নিমাইদাকে ডেকে কী একটা ফর্দ ধরিয়ে দিয়েছেন। বাসলেহর ওষুধের দরকার। বর্ষাকাল, সর্দিজ্বরের প্রকোপ বেড়েছে, ওষুধটি না হলে চলে না। তখনই বাবা গিয়ে নালিশ দিলেন, আর তো ও ঘরে থাকা যাচ্ছে না।
কেন রে?
যতীন বউটাকে রাতে মারে।
মারে কেন?
সে আমি কী করে জানব।
তারপর কেন যে তিনি কী বলেছিলেন, কারণ না থাকলে কেউ মারে!
একবার জিজ্ঞেস করুন ডেকে।
জ্যাঠামশাই হেসে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, তুমি বোঝ না, কেন মারধর করে? যতীন তো আর অমানুষ নয়। মাথায় তার রক্ত উঠে যায় কেন? তুমি হলে কী করতে।
বাবা আর কোনও কথা না বলে যেন পালাতে পারলে বাঁচেন।
জতু ঠিক বোঝে না সব কিছু। তবু সে জানে সারারাত কমলবউকে যতীন দাদা ঠ্যাঙায়। এমন সুন্দর মেয়েটা, বালিকা স্বভাবের, তার মুখে থুতু উঠলে যে কিছু না কিছু গর্হিত কাজ হয়ে থাকে বুঝতে তার কষ্ট হয় না। কমলবউ ডাকলেই সে সাড়া না দিয়ে পারে না।
এমনকী জলে ডুবিয়ে, বার বার ডুবিয়ে, না হল না, আবার ডুব দাও, হল না, ভেসে উঠলে কেন, পায়ের পাতা ভেসেছিল, না হল না, তোমার হাতের আঙুল জলের ওপয়ে থাকলে হবে কেন, নিশ্বাস বন্ধ করে, একেবারে তলিয়ে যেতে পার না, তোমার শরীরে শাড়ি আলগা হয়ে জলে ভেসে থাকে কেন, এভাবে অজস্র ডুব আর ডুব, বালিকা বউটির বয়সি স্বামীর তাড়া থেকে মুক্ত থাকার জন্য ডুব দিতে দিতে হাত পা অবশ হয়ে আসে। ঠোঁট সাদা হয়ে যায়। ঠান্ডায় থরথর করে কখনও কাঁপে।
জতুর কষ্ট হয়। মিছে কথাও বলতে পারে না। পাপ হবে। তাকে দিব্যি দিয়েছে, জতু, আমি ঠিক ডুবে না গেলে, কখনও বলবি না, ডুবে গেছি। বলবি না, আর জলে ডুব দিয়ে কাজ নেই। বললে, তোর পাপ হবে। মিছে কথা বললে, পাপ হয় জানিস!
জতু আজ আলগাভাবেই তেঁতুলগাছের শেকড়ে বসে পড়ল। কতক্ষণে জল থেকে উঠে আসবে কে জানে!
কিন্তু আজ এটা কী করল কমলবউ।
সে তাকাতে পারছে না।
কমলবউ আঁচল শরীর থেকে নামিয়ে দিল।
সেমিজ টেনে খুলে ফেলল শরীর থেকে। তারপর সায়ার ফসকা গেরো টেনে দিতেই, থর থর করে পড়ে গেল পায়ের কাছে। কমল বউ পা দিয়ে সায়াটা তুলে জলে ছুড়ে দিল। শাড়ি ব্লাউজ পা দিয়ে ঠেলে দিল জলে।
কোনও হুঁশ নেই কমলবউয়ের। হাঁসের মতো ঘাটলা থেকে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ডুব দিল। কী একটা ঘোরের মধ্যে আছে যেন।
ডাকল, জতু ধর।
সে চোখ মেলে দেখছে, কমলবউ বুক জলে দাঁড়িয়ে সব সায়া শাড়ি সেমিজ ভালো করে জলে ডুবিয়ে ঢেউ দিচ্ছে জলে।
ধর, বসে আছিস কেন!
জলের নীচে মাছরাঙা পাখি হয়ে ঘোরাঘুরি করছে। এক অতীব আশ্চর্য শিহরণ খেলে গেল জতুর শরীরে।
কী, বসে আছিস কেন। এগুলো তুলে রাখ। জলে ভালো করে ডুবিয়ে দিয়েছি। এবং এমনভাবে জলের মধ্যে কমল ঢেউ খেলিয়ে ভাসিয়ে দিল কাপড় জামা যেন এ শাড়ি সেমিজের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই।