সঙ্গে সঙ্গে মনে হল কাশের ঝোপ ফাঁকা হয়ে গেছে। সামনে সেই মাঠ এবং খালপাড়ের দৃশ্য। একটা লোকও দেখা যাচ্ছে, পায়ের কাছে একটা কুকুর লেজ নাড়ছে। যদিও এত দূর থেকে সব স্পষ্ট নয়, কারণ সূর্যাস্ত হচ্ছে, লাল রঙিন এক জগৎ। এবং তার ভেতর একটা মানুষ আর কুকুর কী যে সুমহান কাব্যগাঁথা। সে তার স্যারের ভাষায় দৃশ্যটাকে উপভোগ করার চেষ্টায় চোখ মেলে তাকাতেই মনে হল লোকটা পরে আছে একটা ঢোলা কালো হাফপ্যান্ট, গায়ে ফতুয়া, মাথায় যেন সত্যি স্বর্ণমুকুট। লোকটা এগিয়ে আসছে, কুকুরটা এদিক ওদিক ছুটছে। লাফাচ্ছে। লেজ নাড়ছে।
প্রিয়তোষ বললেন, ওই আসছে তালেব। আজ বোধহয় ফেরি করতে বের হয়নি। তুই যে আসবি তালেব জানে।
কিন্তু পানু কী বলবে! এমন নিঃসঙ্গ প্রান্তরে একজন মানুষ রাজার মতো দাঁড়িয়ে থাকলে সে কী করতে পারে! মাথায় যে ওটা কী! কখনও মনে হয় নীল কাপড়ের ফেটি, তারপরই সূর্যাস্তের রঙে কেন যে চিকমিক করে উঠতে উঠতে হিরে-জহরত মণিমাণিক্যে ভরা মনে হয়। মনে হয় স্বর্ণমুকুট। এমন একজন মানুষ নদীর পাড়ে বাড়ি করবে ভেবে জমি-জায়গা বিক্রি করে চলে যেতেই পারে। তার যে চাই স্বর্ণমুকুট।
সে নদীর জলে স্বর্ণমুকুট ভেসে যেতে দেখে মাঝে-মাঝে। আর হাতে ওটা কী! কাছে যেতে যেতে সে বুঝল, ওটা লণ্ঠন। জাদুর লণ্ঠন কি না জানে না, কারণ তখন সাঁঝবেলা, আকাশে দুটো-একটা নক্ষত্র ভাসমান, আর হাতে জাদুলণ্ঠনে সে দেখল একটা নক্ষত্র তালেব চুরি করে কাচের ভেতর ভরে রেখেছে। নক্ষত্রটা মিটমিট করে জ্বলছে এবং আলো দিচ্ছে।
সে কেমন মুগ্ধ বিস্ময়ে তালেবের কাছে আসতেই অবাক চোখে দেখল-হাতের লণ্ঠন দুলছে। আলো দিচ্ছে। অন্ধকার চরাচরে লণ্ঠনের এই আলো পানুকে পৃথিবীর অন্য এক প্রান্তে সত্যি যেন হাজির করে দিয়েছে।
তালেব, তুমি আজ ফেরি করতে বের হওনি দেখছি।
বের হয়েছিলাম। রাস্তার মনে পড়ে গেল, খোকাবাবু আসবেন। আমার আর যেতে ইচ্ছে করল না।
পানুর দিকে তাকিয়ে বোধ হয় মনে হল মুখখানা ভাল দেখতে পাচ্ছে না, লণ্ঠন তুলে কাছে নিয়ে দেখতে দেখতে বলল, কী গ খোকাবাবু, চোখে যে আপনার স্বপ্ন ঝোলে-মাকে ছেড়ে এলেন। থাকতে কষ্ট হবে না?
পানু বলল, তুমি টায়ারের স্যান্ডেল পরে আছ কেন? মাথায় নীল কাপড়ের ফেটি কেন?
হা হা করে হাসল তালেব। পানু বুঝতে পারল না দূরে সূর্যাস্তের সময় লণ্ঠনওলার নীল রঙের পাগড়ি কেন তার চোখে স্বর্ণমুকুট হয়ে দেখা দিল। এ এক আশ্চর্য অবলোকন, অথবা কোনো ঘোর থেকে সে দেখে ফেলেছে, লণ্ঠনওলার মাথায় স্বর্ণমুকুট।
সে বলল, তুমি স্বর্ণমুকুট পরেছিলে?
পরেছিলাম।
এখন দেখছি নীল কাপড়ের ফেট্টি তোমার মাথায়!
সে আবার আগের মতোই হা হা করে হাসতে হাসতে মাথা থেকে নীল পাগড়ির কাপড়টা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে প্যাঁচ খুলে মাথা নুইয়ে দেখল।
এ মা, তোমার এক্কে!যারে টাক মাথা।
‘হাত দিন মাথায়’ বলে লণ্ঠনওলা পানুর হাত তুলে মাথায় ঘষে দিতে দিতে বলল, মানুষের যে চাই স্বর্ণমুকুট। কর্তাঠাকুরকে আমার জমি বিক্রি করে দিলাম, সেই লোভে, নদীর পাড়ে বাড়ি, আর নদীর জলে স্বপ্ন দেখা, আপনি বড় হতে হতে টের পাবেন।
এতসব ভারি কথা পানু বোঝে না। সে বলল, একটা নক্ষত্র যে তুমি চুরি করেছ আমি জানি।
আপনি জানবেন না হয়!
তুমি সত্যি তবে চুরি করেছ?
তা করেছি।
লণ্ঠনের কাচের ভেতর ওটা রেখে দিলে কেন?
তা না হলে আলো যে জ্বলে না।
পানু ভেবে পেল না, লণ্ঠনওলা, মানুষ না অপদেবতা।
সে বলল, তুমি কি ভূত!
এবারে প্রিয়তোষ ধমক না দিয়ে পারল না।
পানু, এমন বলতে হয় না।
তারপর তালেবের দিকে তাকিয়ে বলল, আরে তোমরা যে এখানেই জমে গেলে। আরও যে হাঁটতে হয়।
তালেব বলল, চলেন। খোকাবাবুকে আমি কাঁধে নিচ্ছি। কতটা রাস্তা, খোকাবাবু পারবে কেন।
পানু এক লাফে সরে দাঁড়াল। বলল, না, না, আমি হেঁটেই যেতে পারব। কাঁধে নিয়ে তালেব যদি হেঁটে চলে যায়, তাকে নিয়ে ফেরি করতে বের হয়ে যায়—সে হয়তো আর কোনোদিনই তার মায়ের কাছে ফিরে যেতে পারবে না।
তালেব আগে লণ্ঠন দুলিয়ে হাঁটছে।
কুকুরটা আরও আগে দুলকি চালে ছুটছে।
পানু খুবই কাহিল, সে হাঁটতে পারছে না। পায়ে খুব লাগছে, সে বলতেও পারছে না, তার কষ্ট হচ্ছে, বললেই বাবা বলবেন, এজন্যই তোমাকে নিয়ে আসতে চাই না। সে কিছুটা খুঁড়িয়ে হাঁটছে। অন্ধকারে কেউ টের পাচ্ছে না।
তার তালেবকে এখন নানা প্রশ্ন।
এখানে একটা টিলা আছে?
তা আছে।
ভালুক আছে?
তাও আছে।
টিনটিন। টিনটিন। তালেব আর কিছু বলতে পারল না। টিনটিন বলে কোনো জন্তু জানোয়ার আছে সে জানেই না। তালেবের মুখে রা নেই।
কী হল, কথা বলছ না তালেব?
এই, কী হচ্ছে অসভ্যতা! তোমাকে বলেছি না, তালেবকাকা ডাকবে। প্রিয়তোষ পানুকে ধমক দিলেন।
সে তালেবকাকা ডাকবে কী করে! তালেব অপদেবতা না ভূত, কিছুই বুঝতে পারছে না, তাকে সে তার খুড়োমশাই ভাবে কী করে। সেও কেমন চুপ মেরে গেল। সে বলতে পারল না, জঙ্গলে বাঘ নেকড়ে পুষে রেখেছে তালেব আমি জানি।
এখন সবাই চুপচাপ! তালেব টিনটিন নিয়ে ধন্দে পড়ে গেছে। তার পৃথিবীতে ঝোপজঙ্গল জোনাকি, জনমনিষ্যিহীন এক প্রান্তর, প্রান্তর ঠেলে দিগন্তে সব প্রায় মাঠ। মানুষের বসতি, সে ফেরি করতে করতে দু-দিনের রাস্তা হেঁটে চলে যায়, ফেরার পথে গঞ্জ থেকে চাল ডাল তেল নুন কেরোসিন কিনে তার জঙ্গলের ঘরে ফিরে আসে, কোথাও সে টিনটিন কিনতে পাওয়া যায় কি না জানে না। কিংবা টিনটিন জঙ্গলে থাকলে তার চোখে একবার অন্তত পড়ত না, হয় না। সে খোকাবাবুর কথায় এমন জব্দ যে, আর তার রা সরল না।