বাধ্য হয়ে প্রিয়তোষ না বলে পারলেন না, তুমি যাবে। নমিতাকেও বললেন, ওকে জায়গাটা ঘুরিয়ে দেখাব। জায়গাটা নিয়ে পানু নানা আজগুবি চিন্তাভাবনা শুরু করে দিয়েছে। কার্টুনের সব চরিত্র সেখানে পালিয়ে আছে কখন কী করে বসবে তার চেয়ে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া ভাল। শনি, রবিবার থাকব। প্যান্ট-শার্ট আলাদা দিয়ে দেবে। পানুর উদ্ভট চিন্তাভাবনা আমার একদম পছন্দ না।
তুমি ছেলেটাকে নিয়ে শেষে জঙ্গলে রাত কাটাবে! আমার কিন্তু ভালো লাগছে না।
তোমার ভালো লাগছে না, কিন্তু ছেলেটা সেখানে একা চলে গেলে তোমার ভালো লাগবে!
নমিতা অগত্যা নিমরাজি না হয়ে পারল না।
পানু যাবে শুনেই ঘরের মধ্যে ছুটে বেড়াতে থাকল। রাস্তায় ছুটে গেল। ফুল বেচে খায় লোকটাকে বলল, বাবা আমাকে নিয়ে যাবে বলেছে।
এক সকালে প্রিয়তোষ, পানুকে নিয়ে বের হয়ে পড়লেন। তাকে নিয়েই অফিসে যেতে হল। শীতলকুচিতে যান বলে অফিসের কাজ আগেই হালকা করে রাখেন। অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বের না হলে দিন থাকতে জায়গাটায় পৌঁছনো অসম্ভব।
তাঁকে লাউহাটির বাস ধরতে হবে। অফিস ছুটি হলে বাসে জায়গা পাওয়াই মুশকিল। ঘণ্টাখানেক আগে এসেও জায়গা পেল না। দুটো বাস ছেড়ে দিতে হল। পরের বাসে সামনের দিকে জায়গা পেয়ে গেলেন! সঙ্গে একটা ব্যাগ, একটা ওয়াটার বটল। মাঝে-মাঝেই পানু চুক চুক করে জল খাচ্ছে। কোনো উত্তেজনায় পড়ে গেলে এটা তার হয়।
বাসটা এয়ারপোর্ট থেকে জানদিকে ঘুরে গেল। পানু এতক্ষণ একটা কথাও বলেনি। চারপাশে যা দেখছে—পাকা বাড়ি, হাইরাইজ বিল্ডিং, এবং প্রশস্ত রাস্তা সবই তার চেনা। এসব দেখে তার বিন্দুমাত্র কৌতূহল সৃষ্টি হয়নি। এমনকী এয়ারপোর্টের উড়োজাহাজও তার কোনো আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারেনি। ক্রমে বাড়িঘর কমে আসতে থাকলে, বড়ো বড়ো গাছ এবং দুটো-একটা বাংলো টাইপের বাড়ি দেখে কিঞ্চিৎ সে উৎফুল্ল হল। বাস কিংবা অটোরও উৎপাত নেই। দুটো ভ্যানে কিছু লোকজন যাচ্ছিল সে বলল, বাবা দ্যাখো দ্যাখো, ওদিকে তাকাও না!
প্রিয়তোষ দেখলেন, দু-পাশে নয়ানজুলি, দুটো ভ্যান, তারপরই যতদূর চোখ যায় মাছের ভেড়ি—জল আর জল। এবং কিছু ধানের জমি। আসলে সামনেই তাদের নামতে হবে। তারপর হাঁটা। এবং কিছুটা ধানের জমি। কিছুটা রিকশায় গিয়ে নামতে পারে। তবে ঘুরপথ হয়ে যাবে। পানু একবার নুয়ে ব্যাগ খুলে কী দেখল!
কী খুঁজছিস?
সে টেনে বের করল।
প্রিয়তোষ দেখলেন পানু তার এয়ারগান লুকিয়ে সঙ্গে নিয়ে এসেছে।
পানুর বড়োমামা জন্মদিনে এয়ারগানটা দিয়ে গেছেন কবে যেন। এমন একটা স্যাঁতসেঁতে বাড়িতে পানু এয়ারগান দিয়ে কী করবে! টিকটিকি, বড়োজোর দুটো একটা ইঁদুরকে তাড়া করতে পারে। রাস্তার কুকুরকে অবশ্য একবার তাড়া করতে গিয়ে পানুর খুবই ভোগান্তি হয়েছিল। কুকুরের কামড়ে যে জলাতঙ্কের বিষ থাকে সেবারে সুচ ফোঁটাতে ভালোই টের পেয়েছিল পানু। তারপর বোধহয় সে তার এয়ারগানটার কথা ভুলেই গিয়েছিল—সে জঙ্গলে যাচ্ছে, এয়ারগানটা খুবই জরুরি এখনও মনে হতে পারে তার।
পানু তার বাবার সঙ্গে হাঁটছিল। রাস্তার ডানপাশের ভেড়ি ফেলে তারা মাঠের দিকে নেমে গেল। মানুষের কিছু ঘরবাড়িও পার হয়ে গেল তারা। বেড়ার ঘর, নিকোনো উঠোন এবং মানুষজনের সাড়াও পাওয়া গেল। দুটো গোরুর গাড়ি আসছে বাঁশ বোঝাই হয়ে। প্রিয়তোষ একপাশে ছেলের হাত ধরে সরে দাঁড়াল। বাঁশের গাড়ি দেখে পানুর আবার জলতেষ্টা পেল। সে জল খেয়ে ছুটল বাবার পিছু পিছু।
তারপরেই ধানের মাঠ। এবং আল ধরে হাঁটা। কোনো আর রাস্তাই নেই। সে দখল, ধানগাছের গোড়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে। দুটো হলুদ রঙের পাখি উড়ে গেল। কিউ কিউ করে ডাকছে। আশ্চর্য এক জগৎ ক্রমে যেন উদ্ভাসিত হচ্ছে। দিগন্ত দেখা যাচ্ছে। এর পরে বোধ হয় নির্জন খাঁ খাঁ প্রান্তর। খুবই রোমাঞ্চ বোধ করছে পানু। বাবা সঙ্গে থাকায় তার বিন্দুমাত্র ভয়ডর নেই। সেই স্বর্ণমুকুটের লোকটাকেও সে এবার ঠিক দেখে ফেলবে। হাতে জাদুর লণ্ঠন নিয়ে হাজির।
তারপর তারা কাশের জঙ্গলেও ঢুকে গেল। যেদিকে তাকায় পানু, কিছুই আর দেখতে পায় না। কাশের জঙ্গলে তার মাথা ঢেকে গেছে। কিছুটা যেন পাতাল প্রবেশের মতো মনে হচ্ছিল পানর। যদি এ-সময়ে স্বর্ণকুটের লোকটা জঙ্গলের ভেতর থেকে সহসা হাত ধরে টানে, তবে সে নির্ঘাত চিৎকার করে উঠবে। তার যে ভয় ভয় করছিল। এতটা রাস্তা হেঁটে সে খুবই কাহিল হয়ে পড়েছে। ঘামে জবজবে হয়ে গেছে শার্ট-প্যান্ট। ফেব্রুয়ারির মনোরম ঠান্ডা হাওয়াতেও পানু দম পাচ্ছে না। কেবল থেকে থেকে বলছে, বাবা আর কতদূর!
দ্যাখ পানু, এটুকু হেঁটে আর কতদূর বললে কিন্তু সেখানে গিয়ে কোনো মজা পাবি না। এই যে হেঁটে যাচ্ছিস, দু-পাশে মাঠ এবং সূর্যাস্তের কাছাকাছি সময়কার পৃথিবীকে দেখতে পাচ্ছিস, এ বড়োই বিরল দৃশ্য। তুই ছেলেমানুষ, এসব বুঝতে শেখ।
এমন কথায় পানুর খুবই অভিমান হল। আবার ভাবল, বাবা তাকে বোধ হয় গুরুত্ব দিতে চান না। সে তা একবারও বলেনি, বাবা, আমি একটু বসব। এসো গাছটার নীচে বসে একটু জিরিয়ে নিই। বললেই যে সে বাবার কাছে ছোট হয়ে যাবে। বাবা ঠিক বলবেন, জানিস পানু, এজন্যই তোকে নিয়ে আসি না। সে তো শুধু বলেছে, আর কতদূর?