আসলে প্রিয়তোষেরা তিন পুরুষ ধরে ভাড়াবাড়ির বাসিন্দা। তাঁর বাবা শ্যামবাজারের এঁদোগলিতে সেই যে দেশ ভাগের পর এসে উঠেছিলেন আর নড়ার নাম করেননি। রাস্তায় ছিটকাপড়ের ব্যবসা, যার নাম হকারি, এই করে দিনযাপন। যাই হোক, প্রিয়তোষও এই বাসায় শৈশব থেকে বড়ো হয়েছে। ঘুপচিমতো ঘরে এত অন্ধকার যে, দিনের বেলাতেও আলো জ্বেলে রাখতে হয়। চারতলা বাড়ির একতলার স্যাঁতসেঁতে ঘরে তার শৈশব যৌবন কেটেছে, কোনোরকমে পাশটাশ দিয়ে সরকারি অফিসের আবহমানকালের কেরানিগিরিতে ঢুকে যাওয়া ছাড়া উপায়ও ছিল না তার। তার ছেলে পানুও জন্মেছে হাসপাতালে, বড়ো হচ্ছে এ বাড়িতে। টাউন স্কুলে পড়ছে। কাজেই যুক্তির কোনও স্বাদ সে জায়গাটায় গিয়ে আবিষ্কার করে ফেলতেই পারে।
বাড়ি কবে হবে সে অবশ্য জানে না। আর হলেও, এমন একটা জনশূন্য মাঠের মধ্যে থাকা খুব সহজ কথা নয়। তবে স্বপ্ন, পাঁচ কাঠা জমির সবটাই তার। পানু সবসময়ই চঞ্চল স্বভাবের। ভূতের গল্প গোয়েন্দা গল্পের মতো কোনো ঘ্রাণ সে সেখানে না গিয়েও যেন পায়। বাবা কেন যে কিছুতেই নিয়ে যেতে চান না, সে তাও বুঝতে পারে না।
কবে যাবে, বায়না ধরলে, বাবার এক কথা, অতটা রাস্তা হেঁটে যেতে পারবি না। মাঠের মধ্যে একটা কুঁড়েঘরে থাকতে তোর একা ভয় করবে। আমার তো কত কাজ!
কেন, তোমার লণ্ঠনওলা!
আরে সে কখনো ফেরে, কখনো ফেরে না। তার কোনো ঠিক আছে? তাকে আমি থাকতে বলেছি বলে থাকে। সংসারে সে একা মানুষ, বেশিকিছু তার লাগেও না। বয়সেরও গাছ পাথর নেই। খোকাবাবুর জন্য সে একটা জাদুর লণ্ঠন বানিয়ে দেবে, ওটা হয়ে গেলেই সে দেশ ছেড়ে চলে যাবে।
কোথায় যাবে বাবা?
কোথায় যাবে, তা অবশ্য কিছু বলেনি।
তারপরই কী ভেবে প্রিয়তোষ বলেছিলেন, ওর অবশ্য নদীর পাড়ে বাড়ি করার খুব ইচ্ছে। এই যেমন বলে, একটা গাছ, তার নীচে কুঁড়েঘর, সামনে নদী, নদীর জলে স্বর্ণমুকুটের প্রতিবিম্ব।
স্বর্ণমুকুট। তার মানে!
ওর এইরকমেরই কথা। হয়তো বলতে চেয়েছে, নদীর জল কলকল ছলছল। কলকল ছলছলই ওর কাছে স্বর্ণকুট হয়ে গেছে। জলে তার স্বর্ণমুকুট ভেসে যাচ্ছে সে দেখতে পায়।
লোকটা খুব তাজ্জব কথা বলে। তোমার বন্ধু না বাবা?
তা ওইরকমের। নামটাও ভারি মজার। তালেব সরকার। সে অবশ্য বলেছে, কর্তাঠাকুর আমাকে তালেব বলেই ডাকবেন।
তোমাকে কর্তাঠাকুর বলে কেন?
আমার গলায় পৈতে আছে না! পৈতে থাকলে কর্তাঠাকুর ছাড়া সে কিছু ভাবতে পারে না। আমি গেলে তার কাজ বাড়ে। সে আমাকে কিছুই করতে দেয় না। জল তুলে আনা, কাঠকুটো জোগাড় করা, উনুন গোবরে লেপে একেবারে নিরামিষাশী বামুনের আহারের সুবন্দোবস্ত। মাচানে শিম, লাউ, খেতে বেগুন, গাছের কাঁচালঙ্কা তার জমিতেই হয়। কাঠাখানেক জমিতেই প্রচুর ফলন।
তালেব গাছ লাগায় বাবা?
লাগায়। তবে ওই শিম, লাউ, বেগুনের চারা। সেখানে গেলে দেখতে পাবে গাছ লাগালে বড়ো হয় কী করে।
পানুর অবশ্য একটা ফুলের টব আছে। টবে সে গাছ লাগায়। তবে বাঁচে না। রোদ না পেলে গাছ বাঁচবে কেন! সে একটা ভুইচাঁপা লাগিয়েছিল, গাছটা বাঁচেনি। সে রথের মেলা থেকে দোপাটি ফুলের চারা এনেছিল, বাঁচেনি। স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার ঘরে গাছ বাঁচতে চায় না। মেলা রোদ সে রাস্তায় গেলে দেখতে পায়, অথচ বাড়িটায় তাদের রোদই ঢোকে না। বাবা খোলামেলা জায়গায় জমি কিনেছে, রোদ অহরহ এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়ায়, আর রাজ্যের পাখপাখালি, অর্থাৎ প্রাণীজগতের সাড়া পাওয়া যায়, এমন একটা জায়গায় সে না গিয়ে থাকে কী করে!
বাবা সব বলেন না। সেখানে গেলে সে যেন ঠিক একটা ছোট্ট টিলা আবিষ্কার করে ফেলবে। এবং জন্তু-জানোয়ারেরাও ঘুরে বেড়াতে পারে, সে কাঠবেড়ালি, খেঁকশেয়াল গেলেই দেখতে পাবে, সোনালি হয়ে সে ঘুরে বেড়াতে পারবে—কী মজা! সে তো কার্টুন ছবির যম। সুপারম্যান, স্পাইডার ওম্যান, টিনটিনরা বোধ হয়। সেইসব ঝোপজঙ্গলেই লুকিয়ে থাকে। টিভিতে সে যা দেখে, সবই সেখানে ঝোপজঙ্গলে লুকিয়ে আছে এমন মনে হয় তার। বাবা যায়, মাও ঘুরে এসেছে, ঠাম্মা যায়নি, সেও যায়নি। তার খুবই রাগ হয়। রাগ হলে নানা ঝামেলা পাকাতে ওস্তাদ। সে না খেয়ে রাস্তায় দৌড়ে চলে যায়। ফুটপাথ ধরে দৌড়য়।
বাবা পড়ে যান মহাফাঁপরে। সে রাস্তাতেই হাত-পা ছুঁড়তে থাকে, বাজারের সামনে ফুল বিক্রি করে কদম ঠাকুর, সেই বলবে, নিয়ে গেলেই পারেন। ছেলেমানুষ, অলিগলিতে কাঁহাতক ঘুরে বেড়াতে পাবে!
পানু একদিন বলেই ফেলল, বাবা সেখানে ভালুক আছে?
না নেই। ‘বাঘ, হরিণ, টিয়া?
টিয়া আছে। বাঘ, হরিণ নেই।
আছে। তুমি দেখতে পাও না। তালেবকাকা সব জানে। তালেবকাকার কুকুর আছে?
তা আছে। নেড়ি কুকুর। কুকুরটা তালেবের সঙ্গে সঙ্গে ঘোরে।
কথা শোনে?
কথা শুনবে না কেন?
দু’পা তুলে নাচতে পারে?
তুই থামবি পানু?
কবে নিয়ে যাবে, আমাকে কবে জাদুর লণ্ঠন দেবে তালেবকাকা। আমি খাব না বলে দিলাম। আমার রাগ হয় না! দেখবে একদিন আমি নিজেই বের হয়ে যাব। জায়গাটা খুঁজে দেখা দরকার। ঘুরতে ঘুরতে ঠিক জায়গায় চলে যাব!
এই রে! বের হয়ে যেতেই পারে পানু। স্কুলের নীচু ক্লাসে পড়ে। মা তাকে দিয়ে আসে, নিয়ে আসে। এক দুপুরে গিয়ে যদি দেখে পানু স্কুলে নেই, না বলে না কয়ে স্কুল থেকে পালিয়েছে, তা হলেই সমূহ সর্বনাশ।