আর তখনই দেখি আমার ঘাড়ে কার নিশ্বাস পড়ছে। অন্ধকারে কে? মুখ ঘুরিয়ে ছায়া মতো যাকে দেখলাম—তিনি কুট্টি মাসি। অন্ধকারেও চোখ জ্বলছে টের পেলাম।
আমি বললাম, তুমি!
এই প্রথম আমার হাত টেনে মাসি নিয়ে যাচ্ছে। ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর হতাশ গলায় বলল, কী বুঝলি!
আমি তো স্পষ্ট কিছু জানি না। জানি না বললে ভুল হবে যেন সবই বুঝি। তবু কেন যে বললাম, বুঝতে পারছি না।
তুই একটা ম্যাড়া।
আর কী বলি! ঘর থেকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিল।
তারপর ক-দিন আমরা সেই লুকোচুরি খেলায় মত্ত হয়ে গেলাম। বিকালে সাঁকো পারাপারের খেলা। এবারের খেলা জমে উঠল এই কারণে, সবাই আমরা বাঁশ না ধরেই নদী পারাপার করতে পারছি। মাসি একটু দ্রুত পারে। প্রায় দৌড়ে পার হয়ে যায়। তার আঁচল বাতাসে ওড়ে বলে কোনো ব্যালেন্স খুঁজে পায় আঁচল ওড়ার মধ্যে। আমাদের তা নেই—এখনও সতর্ক পা ফেলে পার হতে হয়। আঁচল উড়লে, খসে পড়লে মাসির স্তন দেখে কখনো মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি। মাসি আঁচল সামলে নেমে আসে সাঁকো থেকে। আমার দিকে তাকিয়ে কটাক্ষ হানে।
সেদিন আমরা বাড়ি ফিরছি। প্রচণ্ড ঠান্ডা। শীতে নদীতে স্নান করে হি হি করে কাঁপছি। ক-দিন ধরে সুতিকা গৃহটি পবিত্র করার কাজে মাতামহ খুব ব্যস্ত ছিলেন। ঘরটি স্থায়ী। মা বলতেন, আমিও নাকি এই ঘরটিতেই ভূমিষ্ঠ হয়েছি। মাসিরাও গর্ভসঞ্চার হলে এই গৃহে প্রবেশ করতেন। কুট্টি মাসির বিয়ে হলে সেও আসবে সন্তান ভূমিষ্ঠের কারণে। এ-সব ভাবলে গা সিরসির করত আমার। মাতামহ সূতিকা গৃহটি নতুন করে তৈরি করেছেন। এবার চণ্ডীপাঠ হয়েছে। হোম-যজ্ঞ, দ্বাদশ ব্রাহ্মণ ভোজন সব করা হয়েছে। বেড়ার গাত্রে বেতপাতা, এবং মটকিলার ডাল গুঁজে দেওয়া হয়েছে। বড়ো বড়ো শুকনো কাঠের গুঁড়ি এনে ফেলে রেখেছিলেন। তবু রেহাই নেই। শীতে আন্ধকার নদীতে অবগাহন সেরে ফিরছি। অধিরথ দাদু আগে। হাতে হ্যাজাক। আমার কাঁধে কোদাল। এবার গর্তটি করার ভার মাতামহ আমার ওপর ছেড়ে দিয়েছিলেন। একটু বেশি পরিমাণে গর্ত খুঁড়লে তিনি রুষ্ট কণ্ঠে বললেন, কতদূর যাবে! কতদূর যেতে চাও? আমি এর সঠিক অর্থ ধরতে পারিনি বলে কোদাল চালাচ্ছিলাম। এক ভূতুড়ে ঘোর আমার মধ্যে প্রবেশ করছে। যেন প্রোথিত করার মধ্যে কোনো ফাঁক না থাকে। তারপর সব নামিয়ে দেওয়ার পর কাঁটা গাছ দিলাম কিছু ওপরে। মাতামহ দাঁড়িয়েই আছেন। আর কিছু বলছেন না। কেবল ফেরার পথে বললেন, প্রকৃতিই হেতু। তুমি বড়ো বেশি ভিতু স্বভাবের।
ভিতু স্বভাবের এটা টের পেলাম রাস্তায় ফেরার সময়। মনে হচ্ছিল শিশুটি আমার পায়ে পায়ে হেঁটে আসছে। যেন আমার হাত ধরে হাঁটতে চাইছে। মাঝে মাঝে এমন ঘোর সৃষ্টি হচ্ছিল যে অন্ধকারে কাকে খুঁজছিলাম। কাঁপছি, দাঁত ঠকঠক করছে শীতে না আতঙ্কে বুঝতে পারছিলাম না।
বাড়ি ফিরে আগুনে হাত স্যাকার পর ঘরে ঢুকতেই দেখি মাতামহীর মাথা কোলে নিয়ে মা মেঝেতে বসে আছেন। মাতামহীর চোখ দিয়ে দর দর করে জল পড়ছে। কুট্টি মাসি ছুটে বের হয়ে একটা গরম চাদরে আমার শরীর ঢেকে দিল। তারপর বলল, চল খাবি।
আমার খেতে ইচ্ছে করছিল না। বমি পাচ্ছিল।
কুট্টি মাসি মাকে বলল, দিদি ও তো একা শুতে ভয় পাবে। অধিরথ কাকু শোবে ছোটন কাকুর ঘরে। আমি ওকে নিয়ে যাচ্ছি।
মাসি আমাকে লেপে জড়িয়ে নিলেন। তারপর গভীর রাতে টের পেলাম, মাসি সম্পূর্ণ উলঙ্গ। আমার হাত নিয়ে স্তনে এবং নাভিমূলে নরম উলের গভীর উষ্ণতায় ডুবে গেলেন। শেষে যেন পাগলের মতো আমাকে আঁচড়ে কামড়ে শেষ করে দিচ্ছিলেন। আমি সাড়া দিতে পারছিলাম না। ভয় আতঙ্ক এবং জন্মমৃত্যু রহস্য আমাকে এত আচ্ছন্ন করে রেখেছিল, সকালে উঠে বিষয়টি স্বপ্নবৎ ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারিনি।
সেবারেই মাসি আরোগ্য লাভ করলেন এবং তাঁর বিবাহ পাকা হয়ে গেল।
স্বর্ণমুকুট
শনি, রবিবারই তার পক্ষে প্রশস্ত সময়।
শনিবারেই প্রিয়তোষ অফিস থেকে সোজা শীতলকুচিতে চলে যায়। বাসে ঘণ্টাখানেক, তারপর কিছুটা কাঁচা রাস্তায় তাকে হাঁটতে হয়। গ্রাম জায়গা, ঠিক গ্রাম জায়গা বললেও ভুল হবে, ঘরবাড়ি প্রায় নেই বললেই চলে। কাশের জঙ্গল কিংবা মাঠ পার হয়ে খাল, খালের পাড়ে পাড়ে কিছুটা পথ, তারপর ঝোপ জঙ্গলের মধ্যে কাঠাপাঁচেক জমি তার। জমিটা এক লণ্ঠনওলার। সে জমিটা বেশিদাম পাওয়ায় ছেড়ে দিচ্ছে। তার কুঁড়েঘরটি আছে। প্রিয়তোষের জায়গাটা পছন্দ হয়ে যাওয়ার পর এই কুঁড়েঘরটায় সে শনি, রবিবার গিয়ে থাকে।
এবারে সে বেশ মুশকিলেই পড়ে গেছে। পানু প্রায়ই বলবে, বিশেষ করে শনিবার সকালে, বাবা, তুমি আজ যাচ্ছ।
যেতেই হবে। জঙ্গল সাফ করে ইট বালি পড়ার কথা। কতটা কী হল না গেলে বুঝব কী করে।
তুমি যে বলছিলে আমায় নিয়ে যাবে। ডাহুক পাখি দেখাবে।
প্রিয়তোষের এই স্বভাব। সোমবার অফিস করে বাড়ি ফিরলেই, নমিতা, পানু, এবং মা নানা প্রশ্ন করবেন। তারাও দু-একবার গেছে। নমিতা জমিটা কেনার আগে একবার গিয়েছিলেন, তাঁর খুব পছন্দ হয়নি। বরং কিছুটা ক্ষুব্ধই বলা চলে। শহরের কোনো সুবিধেই নেই, পানুর স্কুল, অসুখবিসুখে ডাক্তার এইসব অসুবিধের কথা উঠেছে। তবে এটাও ঠিক প্রিয়তোষের ক্ষমতাই বা কতটুকু, তার সামান্য চাকরি, এবং কিছু টিউশনি ছাড়া অর্থ উপার্জনের বড়ো আর কোনো উপায় নেই। সামান্য সঞ্চিত টাকায় বাস-রাস্তা থেকে এত কাছে জমি পাওয়াই কঠিন। জায়গাটার উন্নতি কবে হবে তাও ঠিক বলা যায় না। তবু কেন যে প্রিয়তোষের এত পছন্দ! আসলে গাছপালা এবং কিছু গরিব মানুষজন, যেমন লণ্ঠনওলার কথাই ধরা যাক, সে নিজের বাড়িতে বসেই ঝালাই করে, কুপিলক্ষ তৈরি করে এবং ঝুড়িতে বয়ে নিয়ে যায় গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। কোনো ছকবাঁধা জীবন নয় তার। প্রিয়তোষের মনে হয়েছিল লোকটি একেবারে স্বাধীন। ঝোপজঙ্গলের ডাহুক পাখি, তা ছাড়া কাশের জঙ্গল পার হয়ে ঘাস এবং মাঠ সহ কিছু সাদা বকের ওড়াউড়িও তার পছন্দ। খুবই নিরিবিলি জায়গা। কোনো ব্যস্ততা নেই। কেমন এক নৈঃশব্দ্য রাতে বিরাজ করে। খাল পাড় হয়ে একটা শালের জঙ্গল আছে, সেখানে শেয়ালেরা রাতে হু ক্কাহুয়া করে ডাকে।