কী দেখে আসবে!
মাসির তখন কী তাড়া! প্রায় গোপনে জঙ্গলের রাস্তা ধরে ছুটে যেতেন। তার চুল উড়ত। শাড়ির আঁচিল উড়ত। কারণ সাঁঝ লাগার আগে ফিরতে হযে। আশ্চর্য মাসির সঙ্গে গেলে আমরা আর সেই শিশুটিকে খুঁজে পেতাম না। গর্ত খালি। হাঁড়ি ভাঙা। মালসা দূরে পড়ে আছে। শিশুটির কোনো চিহ্ন নেই। দেখতে পেতাম সামান্য দুরে দুটো কুকুর হিজ মাস্টারস ভয়েস হয়ে বসে আছে। ঠোঁট চাটছে।
গেল কোথায়?
মাসি বলত, দেবদূত হয়ে উড়ে গেছে। আমার বিশ্বাস করতে ভালো লাগত। কুকুর দুটির পাশ দিয়ে হেঁটে আসতাম। মাসি তাকিয়েও দেখত না। মাসির চোখে জল চিক চিক করত।
এবারে আমরা আবার যাচ্ছি।
সেই গর্ভধারিণীর গর্ভধারণের খবর।
শরতকাল। ডুলিতে মা, আমি আর বাহার চাচা পেছনে। খাল পাড় হয়ে যতদূর চোখ যায় শুধু আখের জমি। সড়ক ধরে কিছুটা গেলেই আখের জমিতে হারিয়ে যেতে হয়। রাস্তার জ্ঞানগম্যি না থাকলে, সারাদিন আখের জমিতে ঘুরেও বাড়ি ফেরার পথ খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে বড়ো হয়ে যাওয়ায় এবং সঙ্গে বাহার চাচা থাকায় ভয়ডর কম। একই দৃশ্য দেখতে হবে জানি। আমার উপনয়ন হয়ে গেছে। এবারে আর মন্দিরের থান থেকে ফুল বেলপাতা নিয়ে আসার ভার আমার ওপর পড়বে না। কুট্টি মাসিকে দেখার আগ্রহ এবং সাঁকো পারাপারের খেলা আমাকে অধীর করে তুলছিল।
সাঁঝ লেগে গেছিল। কারণ বেহারা চারজন আখের জমিতে পড়ে দিক নির্ণয় করতে পারছিল না। মাঝে মাঝে হাঁকছিল, কই হ! আখের জমির ভিতর চারজন বেহারা আর ডুলিতে আমার মা। মাঠের বিশাল নিমগাছটার নীচে অপেক্ষা করার কথা। আমরা গেলে যাত্রা করার কথা। কিন্তু গিয়ে অবাক, কেউ নেই। ফাঁকা মাঠে একটা গাছ। কিছু বক এবং হরিয়াল পাখি বসে আছে। ভয়ে আমার মুখ চুন হয়ে গেছিল। বাহার চাচা বললেন, তাজ্জব বাত। কিছু করারও নেই। কারণ চারপাশে শুধু আখের জমি দিগন্ত প্রসারিত। সবুজ এবং কখনো ঘন ঘোর কৃষ্ণবর্ণ হয়ে আছে মাঠ। বাহার চাচা নিমগাছের মগডালে উঠে গেলেন। দূরে কী দেখতে পেয়ে কিংবা এস্ত গলা শুনতে পেয়ে হেঁকে উঠলেন–হই হই শব্দটা টেনে এত লম্বা করে বলেছিলেন যে মনে হয়েছিল দূরে আখের খেতে ঝড় উঠে গেছে। খস খস শব্দ। মটমট শব্দ। আখ গাছ ভেঙে কেটে হু হুমনা করে এগিয়ে আসছে কারা।
আসলে দূর থেকে নিমগাছের মাথা দেখা যেতেই পারে কিংবা বাহার চাচার সেই স্ফীত গলায় চিৎকার তাদের কর্ণগোচর হতে পারে। ফাঁকা মাঠে শব্দের সমারোহ প্রবল হয়—দূরের শব্দভেদী বাণ শ্রুতিগোচর হতেই তারা দিক নির্ণয় করে থাকতে পারে। এগিয়ে এলে দূরে আখ জমির উপরে নিমগাছটি দৃষ্টিগোচর হতে পারে—সে যে কারণেই হোক দু-মানুষ লম্বা আখের জমি থেকে ডুলি নিয়ে নিষ্ক্রান্ত হতে পারায় গলদঘর্ম বাহার চাচা স্বস্তি বোধ করেছিলেন। আমার শুকনো মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। আমরা আবার যাত্রা করি।
বেশ রাত হয়ে গেছে। দিঘির পাড়ে হ্যাজাক নিয়ে প্রতীক্ষায় অধিরথ দাদু। দুর্ভাবনা তাদেরও ছিল—রাস্তার কোনো দৈব দুর্বিপাকের শিকারের ভয় তো আছেই। আর এই সব দুশ্চিন্তার মধ্যে মা ডুলি থেকে নেমেই মাতামহীর ঘরে ছুটেছিলেন।
মাতামহী পা ছড়িয়ে বসে আছেন। আমি প্রণাম করতে গেলে রে রে করে উঠলেন তিনি। এসময় প্রণাম নিতে নেই। কুট্টি মাসিকে দেখতে পাচ্ছি না। দেখতে পাওয়ার কথাও নয়। এ-সময় তিনি ঘরের বারই হন না। মা আসায় সবদিক সামলাতে পারবে—মাতামহী কিছুটা নিশ্চিন্ত। কে দেখে!
আমি কুট্টি মাসির মহলে যেতেই দেখলাম বেশ বড়ো হয়ে গেছে। আমাকে দেখে এগিয়ে এল না। প্রণাম করতে গেলে বলল থাক হয়েছে। শোন, তুই এসেছিস ভালো হয়েছে। আমি তো ভাবলাম, তুই এবারে আসবি না। কী যে ভালো লাগছে। তোর তো উপনয়ন হয়ে গেছে।
উপনয়ন হয়ে গেলে কি মানুষের দ্বিতীয় জন্ম শুরু হয়। জানি না। তবে খাওয়া-দাওয়ার পর, দেখি আমার শোওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে ছোটন দাদুর ঘরে। পালঙ্কটা ছোটো। দু-জন শুতে পারে। তবু আপাতত রাতের মতো এই ব্যবস্থাই থাকল। …..শীতকাল, জড়াজড়ি করে শুয়ে থাকলে ওম বেশি। রাতটা সেভাবেই কাটল। এখন কটা দিন আবার বাড়িতে আগের পরিস্থিতি। এবারে মাতামহীর মাঝে মাঝে ফিট হচ্ছে। দিন যত এগিয়ে আসতে থাকল, মাতামহীকে নিয়ে টানাপোড়েন বাড়ছে। এক দিন মা কিঞ্চিৎ রুষ্ট গলায় চেঁচামেচি করতেই ছুটে গেছিলাম। আড়ালে দাঁড়িয়ে যা শুনলাম স্তম্ভিত।
মানুষটার কী দোষ বল। রাগ করিস কেন বুঝি না।
তাই বলে…মা কেমন কাঁপা কাঁপা গলায় কথা বলছিল।
মা আবার বলছিল, আমি জানতাম।
মাতামহী বলছিল, আমি তো চেষ্টা করছি সামলাবার।
মার গলা–বাবার চিঠি পেলে অস্থির হয়ে পড়তাম। শেষমেশ কী যে কপালে লেখা আছে। আর বলি নবীন ভট্টাচার্যের আক্কেল নেই। ঘোরাঘুরি করছে!
তোর বাবার খুব পছন্দ।
মরণ!
মার এই মরণ কথাটি যে ঘৃণা বিদ্বেষ থেকে প্রসূত টের পেতে কষ্ট হল না।
মরণ বলছিস কেন! তার শরীর বলে কথা। তাকে দোষ দিচ্ছিস কেন। আর ঠিক এ-সময়ে বনজঙ্গল পার হয়ে ঢাকের বাদ্য শুরু হয়ে গেল। সেখানে দেবীর আরতি হচ্ছে। ধূপ দীপ জ্বলছে। মাতামহ গদগদচিত্তে মাতৃ আরাধনায় মত্ত। আর কিছু শুনতে পেলাম না।
সব আমার কাছে স্পষ্ট না হলেও ঘোর বিপত্তি দেখা দিয়েছে পরিবারে বুঝতে পারি। এই আশঙ্কা হয়তো মা আরও আগেই টের পেয়েছিলেন। গুরু বংশের দোষ। চিঠি পেলেই সব আশঙ্কা প্রবল হত। মাতামহী আর পারছেন না তবু চেষ্টা যদি ধরে রাখা যায়।