আসলে মামাবাড়িতে গেলে আমরা কোথায় কে শোব ঠিক করে দিতেন মা। কুট্টি মাসির আবদার রক্ষার্থেই আমি, আন্না মাসি, কুট্টি মাসি এক পালঙ্কে শুতাম। এতে কুট্টি মাসির মধ্যে বেশ স্বাভাবিক স্বভাব ফুটে উঠত। আমরা বিকালে কোনোদিন এককা দোককা খেলতাম। কিংবা পাশান্তি। অধিরথ দাদুর পঙ্গপালও আমাদের সঙ্গে তখন জুটে যেত। কখনো গভীর জঙ্গলে ঢুকে গেছি। কুট্টি মাসি ঝোপ জঙ্গলের নড়ানড়ি দেখে টের পেত কে কোথায় আছে। সেই কুট্টি মাসির অস্বাভাবিক আচরণ দেখে ক্ষোভ হত—বলতাম, আর কোনোদিন শোব না। দরজা বন্ধ করে দিলে কেন! কুট্টি মাসি আমার দিকে অপলক তাকিয়ে বলত, সোনা আমার। রাগ হয়েছে। রাগ কার ওপর এত। তোরা তো কুকুর বেড়ালের অধম।
আমি এসে মাকে নালিশ দিতাম।
মা বলতেন, বলুক গে! ওর কি মাথার ঠিক আছে। ওর কথা ধরিস না।
সেবারে কেন যে মাকে সহসা প্রশ্ন করেছিলাম, জানো মা দাদুর বৈঠকখানায় কেউ নেই। দাদু কোথা। দরজা জানালা বন্ধ।
অন্দরে।
অন্দরে কোথায় মা?
তিনি এতে অস্বস্তি বোধ করতেন। বলতেন, রাত হয়েছে শুয়ে পড়। বকবকানি আর ভালো লাগছে না।
আমিও নাছোড়বান্দা দাদুর শোওয়া বসার বিষয়টিতে যেন কোনো পারিবারিক মর্যাদা জড়িত থাকত। দাদুর কাজকামে আমার অশেষ কৌতূহল। সেই দাদুর অন্তর্ধান আমার কাছে বিস্ময় ছিল। মাতামহীর মহলে মাতামহকে আমি খুব কমই দেখেছি। কিংবা কোনো কারণে মাতামহীর পরামর্শ দরকার হলেও তিনি বাইরে দাঁড়িয়ে গলা খাকারি দিতেন। ঘরে ঢুকতেন না। সেই মাতামহ বৈঠকখানায় নেই, বৈঠকখানায় থাকলে জানালা খোলা থাকত। একটা সেজবাতি জ্বলত। না কিছু ছিল
বলতাম, জানো মা বৈঠকখানার সব দরজা জানালা বন্ধ। সেজবাতি জ্বলছে না। বারান্দায় অধিরথ দাদু শোয়, সেও নেই।
মা না পেরে বলত, তোমার দাদুর শরীর খারাপ। ভিতর বাড়িতে তিনি শুতে গেছেন। ভিতর বাড়িতে! কোথায়।
ইস তুই এত জ্বালাস। তুই কী রে। দাদুর বয়স হয়েছে না। শরীর খারাপ হতে পারে না। একা মানুসটা বৈঠকখানায় পড়ে থাকবে! দেখে কে! তুই ঘুমাবি, না বকবক করবি।
বুঝতাম, মা মাতামহর প্রসঙ্গ নিয়ে একদম কথা বলতে চান না আর। চুপ মেরে পাশ ফিরে শুয়ে পড়তাম। কুট্টি মাসির পাশে শুলে হুটোপাটির শেষ থাকত না। এ ওর চাদর টেনে, বালিশ টেনে কাড়াকাড়ি শুরু হত। জানালার দিকে কেউ ভয়ে শুতে চাইত না। কারণ জানালা দিয়ে গাছপালার ফাঁকে দূরের হাটবাজার দেখা যায়, আর ক্রোশ খানেক গেলে শ্মশান দক্ষিণের বাতাসে মরা পোড়ার গন্ধ পর্যন্ত কখনো ভেসে আসত। রাত হলেই ঝোপ জঙ্গলে জোনাকি জ্বলত, শেয়াল ডাকত বড়ো জঙ্গলে, শ্মশান থেকে যে সব মৃত আত্মারা ভেসে আসত তারা সহজেই জানালা গলিয়ে হাত বাড়াতে পারে। এমন আতঙ্কে আমরা সবাই কাবু। কুট্টি মাসি জানালার পাশে শুত—যেন তার ভয়ডর কম। কিন্তু সকালে ঘুম ভাঙলে দেখতাম, জানালার পাশে আমি। খেপে যেতাম। ঠিক ঘুমের ঘোরে কুট্টি মাসি আন্না মাসি আমাকে চ্যাংদোলা করে জানালার পাশে এন ফেলে রেখেছে! খেপে গেলে কুট্টি মাসি বলত, তোর যা শোওয়া, কখন কাকে লাথি মারিস ঘুমের ঘোরে। কখন কাকে টপকে যাস ঘুমের ঘোরে—আর যত দোষ আমার!
বিশ্বাসও করতে পারতাম না, আবার অবিশ্বাসও করতে পারতাম না। আমার শোওয়া ভালো না, মা বলতেন। খাটের এক পাশে শুলে শেষ রাতে আর এক পাশে গিয়ে পড়ে থাকি। মশারির ফাঁকে ঠ্যাং ঝুলে থাকে। মা নাকি ঠ্যাং তুলে দেয়। ঘুমের ঘোরে লাথি ছুঁড়ে মারি, কত যে অভিযোগ!
অথচ পরদিন সকালে ঘরে শুয়েই শুনতে পাই মাতামহ ভরাট গলায় স্তোত্র পাঠ করছেন। তাঁর ক’ উদাত্ত। ভোর রাতের দিকে শুকতারাটি জ্বলজ্বল করছে। খড়মের খটাস খটাস শব্দ উঠছে। স্তোত্রপাঠ, নীল আকাশের শুকতারা, এবং গাছপালা পাখির ওড়াউড়ি মিলে বাড়িটায় অন্য একটি গ্রহ তৈরি হত।
কে বলবে মাস খানেকও হয়নি, এ-বাড়িতে একটি শিশুমৃত্যু হয়েছে। তার কথা কেউ আর মুখে উচ্চারণই করে না। অথচ বীভৎস দৃশটি ভাবলে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। হাঁড়ির মুখে ঢুকছে না। মাতামহ মট মট করে শিশুটির হাত পা ভেঙে দিতেন। ঘার মটকে দিতেন। তারপর ভিতরে ঢুকিয়ে মালসায় ঢেকে হাঁড়িটি গর্তে রাখতেন। মাটি চাপা দিতেন। তাঁর বোধ হয় অভ্যাস হয়ে গেছিল। বিষয়টি তাঁর কাছে মন্দিরে জোড়া পাঁঠা বলি দেবার চেয়ে বোধ হয় বেশি গুরুত্ব পেত না। নদীর ঘাটে এসে স্নান পর্ব সারা হত। বটুক ভৈরবের স্তোত্র পাঠ হত। আমরা ফিরতাম। মনে হত সেই শিশুটি হাঁড়ির ভিতর ঘুমিয়ে আছে। কিংবা তার দু-বাহু খুঁজছে হাঁড়ির ঢাকনা খুলে আবার পৃথিবীর গাছপালার ভিতর শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়া যায় কিন না।
সব চেয়ে আতঙ্কে পড়ে যেতাম কুট্টিমাসির ডাকে।
আমায় ডাকতেন, দিবানাথ, দিবানাথ।
আমি সাড়া দিলে বলতেন, এদিকে শোন।
ঘরে গেলে বলতেন, বাবা কোথায় জানিস?
মাতামহ বিকালে সেদিন বাড়ি ছিলেন না। কার্য উপলক্ষে দু-ক্রোশ দূরে দুপতারার হাইস্কুলে গেছেন। স্কুলের নির্বাচন। তিনি একজন প্রার্থী। তিনি বলতে গেলে অঞ্চলের সব। ইউনিয়ন বোর্ডের সভাপতি। বাড়িতে বৈঠকখানার পাশে। একটি অস্থায়ী টিনের ঘরে নীল বাক্স। ডাকঘরটির মাথায় জালালি কবুতর। সামনে বড়ো বড়ো অর্জুন গাছ—এবং মানুষজনের চলাচল। কর্মব্যস্ত মানুষটির সঙ্গে দু-জন সঙ্গী থাকত সব সময়। তারা যখন নেই, তিনিও বাড়ি নেই। খবরটা মাসিকে দিতেই বলেছিল, চল। দেখে আসি।