কারণ কে জানে কখন কোন ঝোপ জঙ্গলে লুকিয়ে পড়ব। ডেকে সাড়া পাওয়া যাবে না। বাড়িতে হুলুস্থুল কাণ্ড। যতক্ষণ না শিশুটির সদগতি হচ্ছে, বাড়িটা নরক হয়ে থাকবে।
ছোটাছুটি। জল জল। হাওয়া কর। তামার পয়সা আন। দাঁত লেগে গেছে কুসুমের। লবঙ্গ পোড়াও চোখে জলের ঝাপটা দাও। যতক্ষণ না ফুল বেলপাতা নিয়ে যাব, কুট্টি মাসি বিসর্জনের প্রতিমা হয়ে মেঝেতে পড়ে থাকবেন।
বোধহয় সেই কষ্টদায়ক অনুভূতিও আমাকে সেবারে তাড়া করে থাকতে পারে। আমি বেশ পা চালিয়ে বাড়ির কাছে হেঁটে এসেছিলাম। তারপর দৌড়ে বাড়ি ঢুকে পলকে হাঁড়ির ভিতর ফুল বেলপাতা রেখে ঘরের ভিতর অদৃশ্য। জামা-প্যান্ট পরে নিষ্ক্রান্ত হলে, মাতামহ বলেছিলেন, অনুসরণ করো।
মা কোত্থেকে ছুটে এসে পাগলের মতো ডাকতে থাকলেন, দিবানাথ, বাবা দিবানাথ একটু দাঁড়া বাবা।
আমি দাঁড়ালে কোমরের ঘুনসিতে হাত দিয়ে কী যেন খুঁজলেন। তারপর নিশ্চিন্ত হয়ে বললেন, যাও।
এতটা নিশ্চিন্ত হবার কারণ, আমি আবার কোনো অশুভ আত্মার প্রভাবে না পড়ে যাই। অশুভ আত্মার প্রকোপ বাড়িটার চারপাশে ঘোরাঘুরি করছে—বিশেষ করে সেই নির্জন নদীতীরের পরিত্যক্ত ছাড়াবাড়িতে শিশুদের সদগতির আশ্রয়টি যে মোটেই নিরাপদ নয়, মা বিশ্বাস করতেন। আমার ঘুনসিতে তিনি কী খুঁজছিলেন। তাও জানি। জালের কাঠি ঘুনসিতে বাঁধা থাকলে অশুভ আত্মার নজর লাগে না এমন বিশ্বাস তাঁর প্রবল। আমার ঘুনসিতে একটা জালের কাঠি, ফুটো তামার পয়সা আর রুদ্রাক্ষ গাঁথা আছে। ঘুনসি ছিঁড়ে গেলে এটা ওটা হারায়। মা আবার যত্নের সঙ্গে ঘুনসিতে তা জড়িয়ে দেন। আমার অনুসরণের পালার সময় মা-র হয়তো মনে হতে পারে প্যান্টের সঙ্গে ঘুনসিটাও খুলে গেছে। আপদের তো শেষ নেই।
বাড়ি থেকে নিষ্ক্রান্ত হলেই বনজঙ্গল। সরু রাস্তা হাটে যাবার। হাট পার হয়ে ক্রোশ খানেক গেলে শ্মশান এবং নদীর চড়া। চড়াটা বর্ষায় ডুবে গেলে পাশের ছাড়াবাড়ি সম্বল। হেমন্তের সময় ছিল। সেটা। গাছপালার ভিতর দিয়ে সবার আগে মাতামহ, পেছনে আমরা। একেবারে শেষে অধিরথ দাদু। চড়ার মাটি তুলে হাড়িটা বসিয়ে দেওয়া হল। কাঁথা কাপড়ের মধ্যে মাতামহের পক্ষকালের জাতক। গত তিন চারদিনই বাড়ির কারও ঘুম ছিল না। শিশুটির মধ্যে ভূতুড়ে কান্নার লক্ষণ প্রকাশ পেতেই ওঝা গুনিন সব ছুটে এসেছে। কিম্ভুতকিমাকার পোশাক। নখ, বড়ো বড়ো দাঁত বের হয়ে আছে। ঝোলায় ঝাঁটা থেকে কুরুণ্ডি গাছের মূল। হোমিওপ্যাথ ডক্তারও ঘুরে গেছেন সাইকেলে—যেখানে যত ওঝা বদ্যি আছে সবার কাছে খবর চলে গেছিল। দিঘির পাড় ধরে উঠে আসছিল।
কে আসে?
গুনধর ওঝা আসে।
কে আসে?
নিকু গুনিন আসে।
খবর যায় অন্দরমহলে। আমরা সন্ত্রস্ত দিনরাত। কুট্টি মাসির নাওয়া খাওয়া। বন্ধ। অরাজক অবস্থা।
জাতকের খিচুনি ধরে গেছে। হাত পা ছুঁড়ছে। দাপাচ্ছে। বুকের দুধ মুখে দিচ্ছে। দিন রাত মা পায়ের ওপর রেখে, কখনো বুকে রসুন তেল মেখে দিচ্ছে। হাত মুঠো করে পৃথিবী বিদীর্ণ চিৎকারে যখন সারা বাড়ি তটস্থ মাতামহ তখনও নির্বিকার। তার পূজা আর্চা হোমের কোনো খামতি নেই। মন্দিরে আরতি হচ্ছে— পঞ্চপ্রদীপ জ্বলছে। ধূপদীপের গন্ধ এবং জোড়া পাঁঠাবলি। মৃত্যু শেষ কথা নয়। ডুব মাত্র অশৌচ। নদীর ঘাটে ডুব দিয়ে ফিরে এলে, বাড়িটা আবার ক্রমে স্বাভাবিক হয়ে উঠত। মাতামহীর শোক থাকত সপ্তাহকাল। তারপর তিনি ধীরে ধীরে উঠে বসতেন, খেতেন। খোঁজখবর নিতেন সবার। তারপর দেখতাম পায়ে আলতা পরে পাট ভাঙা শাড়ি পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আচড়াচ্ছেন। মুখে পাউডার মাখছেন। সুঘ্রাণ উঠছে শরীরে।
চুল উঠে যাচ্ছে গোছা গোছা।
মাতামহীর মুখে চোখে উদ্বেগ।
ডাকতেন, চাঁপা, চাঁপা!
মা কাছে গেলে চিরুনি থেকে চুল গোছ করে তুলে আনতেন। দলা পাকাতেন। তারপর মাকে দেখাতেন।
আমার সব চুল উঠে যাচ্ছে!
মা বলত, কত চুল তোমার মা।
চুল আর আছে! সব যে উঠে গেল! কী হবে!
মাতামহী চুলের গোলাটায় থুতু ছিটিয়ে জানালার বাইরে নিক্ষেপ করার সময় মাতামহর খোঁজ নিতেন।
আমি ঠিক বুঝতাম না, কেন এই খোঁজ।
তারপরই বৈঠকখানা দেখতাম খালি হয়ে যেত রাত দশটা না বাজতেই। বৈঠকখানার পালঙ্কে বিছানা হত না। মাতামহ অন্দরে শোবেন ঠিক হয়ে যেত।
কুট্টি মাসি দরজায় দাঁড়িয়ে বলত, দিদিকে ডাকল কেন রে!
দিমিমার চুল উঠে যাচ্ছে।
বাবা কোথায়?
জানি না তো!
রাত দশটায় কুটি মাসি আমাকে দাদুর বৈঠকখানা দেখে আসতে বলতেন।
আমি দৌড়ে অন্দরের উঠোন পার হয়ে দরদালানের বাইরে চলে আসতাম। একটা হ্যাজাক জ্বালিয়ে রাখা হয় বারান্দায়। বৈঠকখানায় মাতামহের শুতে শুতে রাত বারোটা—সেদিন দেখি, বৈঠকখানায় দরজা জানালা দশটা বাজতেই বন্ধ হয়ে গেছে। কেমন নিঝুম পরিবেশ। ছাদের মাথায় জাম গাছের একটা বড়ো ডাল জ্যোৎস্নায় শুধু জেগে আছে। ভয়ে গা সিরসির করে উঠলে দৌড়ে পালাতাম। আর আশ্চর্য কুট্টি মাসিকে খবরটা দিতেই বলত, যা তোর মার সঙ্গে গিয়ে শুয়ে থাক। বলে মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিত। কেন যে আমার দিকে তাকাতেই তখন চোখে জ্বালা ফুটে উঠত জানি না।
মাকে গিয়ে বলতাম, মা কুট্টি মাসি দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। আমি কোথায় শোব?