আমাদের সাঁকোর খেলাটা সে-জন্যই এত প্রিয় ছিল। মাতামহ বাড়ি থাকলে কুট্টি মাসি, বনজঙ্গল পার হয়ে নদীর পাড়ে চলে আসতে পারত। আমার সঙ্গে কটি মাসি থাকলে স্বাভাবিক থাকবে এই ধারণা থেকেও বিধিনিষেধের বেড়া কিছুটা আলগা করে দিতেন মাতামহ। অসূর্যম্পশ্যা নারী। শাড়ি পরার সঙ্গে এ গৃহে নারীরা অসূর্যম্পশ্যা হয়ে যায়। বুকে সুপারির মতো স্তন ওঠার সঙ্গে শাড়ির ছিল গভীর সম্পর্ক। ফ্রক পর নিষেধ। সতর্ক নজর মাতামহের। মাতামহী কিছুটা আলগা স্বভাবের। তার পানের ডাবর এবং সুপারি কাটার জাতি সামনে থাকলে তিনি স্থিরচিত্ত থাকতেন। রান্নাবাড়ি সামলাবার দায় একজন ঠাকুরের। সেই মাতামহীর লিস্টি মতো জলখাবার থেকে ভোজনের ব্যবস্থা করে থাকে। ঘরের ভিতর বিশাল পালঙ্ক। খাটের পায়াগুলি সিংহের থাবা যেন। এক পাশে কাঠের একটা বিশাল সিন্দুক। দেড় মানুষ উঁচু সিন্দুকটির কপালে অজস্র সিঁদুরের ফোঁটা। একটা কড়াতে মালি সোলার এক জোড়া কদম ফুল। প্রশস্ত ঘরের জানালা এত ছোটো যে বাইরের আলো ভালোভাবে প্রবেশ করতে পারত না। আমাদের যখন তখন ঢোকা ছিল বারণ।
আমি সেবারে হাতে বাসি ফুল বেলপাতা নিয়ে বাড়ি ঢুকতে সংকোচ বোধ করছিলাম। অথচ তার আগের বার ঘাটলায় গেলেই জামা প্যান্ট খুলে দিঘিতে সাঁতার কাটার নেশা ছিল। কিন্তু সেবারে আমি রাজি না।
অধিরথ দাদু বলেছিলেন, আপনার কী হয়েছে। দাঁড়িয়ে থাকলেন!
আমার কী হয়েছে বোঝাই কী করে! আমার লজ্জা করে বলার পরও যদি তিনি জোর খাটান আমি যাই কোথায়!
অবশ্য আমি জানি এই নিয়ম।
এর আগের বার কুট্টি মামার ওপর ভার পড়েছিল। কুট্টি মামা সহজেই থানের আশীর্বাদী ফুল বেলপাতা নিয়ে উলঙ্গ অবস্থায় হাজির হয়েছিলেন। আমার পালার সময়, পারছি না। কুট্টি মামা পারলেন, আমি পারছি না। কিংবা সেবারে কুট্টি মামাকে না পাঠিয়ে আমাকে কেন পাঠানো হল আশীর্বাদী ফুল বেলপাতা আনতে বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
অধিরথ দাদু আমার গোঁ দেখে বিপাকে পড়ে গেছিলেন। ওদিকে মাতামহ অপেক্ষা করছেন জানি।
অধিরথ দাদুর ওপর বিরক্ত হতে পারেন। সেই ভয়েই হয়তো বলেছিলেন, দাঁড়িয়ে থাকবেন না ঠাকুর। দেরি হয়ে যাচ্ছে। কর্তার মাথা গরম হলে কী হয় জানেন। তিনি কাউকে আস্ত রাখেন না। অধিরথ দাদু আলগা দাঁড়িয়ে আছেন। পাঁঠাবলির সময় তাকে নিষ্ঠুর মনে হয়। রক্তচক্ষু হয়ে যায়। আমার ওপর বোধ হয় সে-ভাবে হম্বি-তম্বি করারও অধিকার নেই। তবে টের পাচ্ছিলাম, চোখ নিষ্ঠুর প্রকৃতির হয়ে উঠছে। হাতে রামদা থাকলে এই গভীর বনজঙ্গলে দেবীর নামে উৎসর্গ করে দিতে পারেন। আতঙ্কে আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। অভিযোগ, আমাকে কেন! কুট্টি মামা এল না কেন।
কুট্টি মামা বড়ো হয়ে গেছে না!
বড়ো হয়ে গেছে তো কী হয়েছে!
উপনয়ন হয়ে গেছে ঠাকুরের। তিনি পারবেন কেন!
ইস কুট্টি মাসির সামনে পড়লেও রক্ষা থাকবে না। মাতামহের অনুপস্থিতিতে আমাকে বিড়াল কুকুরের মতো তাড়া করবেন। কী কারণে একবার প্যান্ট ছাড়ার সময় উলঙ্গ হয়েছিলাম—কুট্টি মাসির সে কী ক্ষোভ।-কুকুর! কুকুর কোথাকার। আমি তাড়াতাড়ি প্যান্ট পরে ফেললে মাসি আমাকে জড়িয়ে ধরে আদর করেছিলেন।
চুমু খেয়েছিলেন কপালে। তারপর আমাকে নিয়ে দৌড়ে নদীর পাড়ে এসে সাঁকো পারপারের খেলা শুরু করে দিয়েছিলেন।
শিশুটিকে নির্জন ঝোপ জঙ্গলে পুঁতে দেবার আগে এই আশীর্বাদী ফুল বেলপাতা দরকার।
দরকার নতুন হাঁড়ি পাতিলের।
দরকার পঞ্চ শস্যের।
মন্ত্রপূত জবাফুল দেওয়া হয় হাঁড়িতে।
অপদেবতার ছড়াছড়ি। পর পর শিশুমৃত্যু। পেঁচোয় পাওয়া যাবে বলে। প্রাথমিক কর্তব্য শিশুটিকে বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া। যতক্ষণ থাকবে মাতামহী পাগলের মতো প্রলাপ বকবে। এবং তার চিল কান্না গগনভেদী তীর্যক বজ্রপাতের মতো। সারা বাড়িতে অস্বাভাবিক আচরণ চলছে। কুট্টি মাসির এ-সময় ফিটের ব্যামো দেখা দেয়। গর্ভসঞ্চারের পর থেকেই কুট্টি মাসি কেন খেপে যায়, আর ক্রমে এই খেপে যাওয়া অস্থিরতায় ডুবে গেলে, কুট্টি মাসির দাঁত লেগে যায়। হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে।
বাড়ি থেকে মৃত শিশুটি নিক্রান্ত হলে সবাই চুপ মেরে যায়। গৃহে কেউ বসবাস করে মনে হয় না। কুট্টি মাসি কেমন আছে কে জানে! সুন্দর সরল চোখ এই মৃত্যু পর্বে হিংস্র হয়ে ওঠে। হাতের কাছে যা পায় ছুঁড়ে ফেলে। বাড়িতে ভাঙচুরের পর্বটিও শুরু হয়। মাতামহ জানেন, শিশুটিকে মাটি না দেওয়া পর্যন্ত বাড়ির অস্বস্তি কাটবে না। সে-জন্যও অধিরথ দাদু অপেক্ষা করতে পারছিলেন না। আমাকে একা ফেলে কবর দিতে যেতে পারছেন না। গিয়ে বলতে পারছেন না, ঠাকুরের পোঁ, ন্যাংটা হয়ে বাড়ি ফিরবে না।
তারপরই রুদ্রমূর্তি।
ঠাকুর ভাবছটা কী! হাঁটো। না হাঁটলে ঠাং ভেঙে দেব।
বুঝতে পারি ক্রোধ সীমাহীন। আর উপেক্ষা করা ঠিক হবে না। কড়া ভাষা ব্যবহারের রীতি শুরু হয়ে গেছে। আপনি থেকে তুমিতে নেমে এসেছে। ভয় প্রদর্শন করছে। জানো ইচ্ছে করলে তোমাকে পাঁজা কোলে করে নিয়ে যেতে পারি! জানো ইচ্ছে করলে তোমাকে নদীর জলে চুবিয়ে মারতে পারি। এক কোপে দু-খান করে দিতে পারি। আমি পারি না হেন কাজ নেই। হাঁটো!
অগত্যা আর কী করা। আমার কান্না পাচ্ছিল। ফুঁপিয়ে কাঁদছিলাম জঙ্গলের ভিতর দিয়ে হাঁটছি। এক হাতে ফুল বেলপাতা, অন্য হাতে চোখের জল মুছছি। লজ্জায় কান্না পায় সেই প্রথম টের পেয়েছিলাম। তারপর মনে হয়েছিল যেন, ঠিক লজ্জা না, আমাকে উলঙ্গ থাকতে বাধ্য করা হচ্ছে। ক্ষোভ হতেই পারে। ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ কে সহ্য করে! ক্ষোভবশত কান্নার উদ্রেক। জামা-প্যান্ট পরে গেলে অশুচি ভাববেন মাতামহ। অশুচি অবস্থায় থান থেকে ফুল বেলপাতা সংগ্রহ করা বিধর্মীর লক্ষণ। অধিরথ দাদুর ওপর ক্রোধে আচ্ছন্ন হলে তাঁরও রক্ষা থাকবে না। অধিরথ দাদু আমার পেছনে।