মাতামহর গলায় গাম্ভীর্য এ ত যে, শেষ পর্যন্ত আর পালিয়ে থাকতে পারিনি। তিনি অধিরথ দাদুকে দিয়ে আমাকে মন্দিরে পাঠালেন। আমাকে উলঙ্গ হয়ে মন্দির থেকে ফুল বেলপাতা তুলে আনতে হবে। ফেরার সময়ও উলঙ্গ। আমার জামা প্যান্ট অধিরথ দাদুর হাতে। তিনি মন্দিরের সামনে গেট খুলে বলেছিলেন, নিশ্বাস বন্ধ করে দৌড়ান। মন্দিরের চারপাশে বিশাল পাঁচিল। মন্দিরটি এক কোনায়। মন্দিরের বাইরে খোলা আকাশের নীচে একটি থান আছে। থানটি তেল সিঁদুরে মাখামাখি। চত্বর বাঁধানো থানের ওপর বাসি ফুল বেলপাতা। মাতামহ মন্দিরের পূজা শেষ করে থানে পূজা দিতেন। মন্দির গর্ভে করালবদনা দেবীমূর্তি। কষ্টি পাথরের। তার রক্ত জিভ লকলক করছে। মাথায় সোনার মুকুট এবং নাকে একটি বৃহৎ নোলক। সাধারণের প্রবেশ নিষেধ। যার যা মানত থানে। মন্দির গর্ভে প্রবেশের অধিকারী আমার মাতামহ এবং তার অনুপস্থিতিতে ব্রাক্ষণদির বিজয় চক্রবর্তী। তিনি সম্পর্কে আমার মেসো হন। বর্ষাকালে মাতামহ শিষ্যবাড়ি ঘুরে বেড়ান। সে এক এলাহি বন্দোবস্ত। ঠাকুর চাকর, দুজন মাঝি এবং একটি পানসি নৌকায় তাঁর বিলাস ভ্রমণ। শীতেও বের হয়ে পড়েন—অর্থাৎ মাতামহীর গর্ভধারণের সময় কাল বুঝে তিনি পর্যটনে বের হতেন।
বিশাল পাঁচিল দিয়ে ঘেরা মন্দিরের ঢোকার সদর দরজাটি তালাবন্ধ থাকত। অসময়ে মানত দিতে এলে পাঁচিলের বাইরে থেকে পয়সা ছুঁড়ে দিতে হত থানে। জাগ্রত দেবী বলে কেউ থানের পয়সা তুলে নিতে সাহস পেত না। কেউ কেউ পাঁচিল টপকে জোড়া পাঁঠা ছেড়ে দিয়ে যেত। অধিরথ দাদুর কাজই ছিল পয়সা এবং পাঁঠা সংগ্রহ করে নিয়ে যাওয়া। মন্দিরে মাতামহ আসতেন দুপুরে। পূজা শেষ করতে বেলা গড়িয়ে যেত। রাতে পঞ্চপ্রদীপ, শঙ্খ এবং ধূপের সমারোহ। ঢাকি ঢাক বাজাত। অঞ্চলের মানুষজন চত্বরে দাঁড়িয়ে দেবী দর্শন করতেন। মাতামহ কেমন অন্য এক গ্রহের বাসিন্দা হয়ে যেতেন। চামরের হাওয়ায় দেবীর ফুল বেলপাতা যেন ওড়াউড়ি শুরু করে দিত। মাতামহের সঙ্গে আমি, ছোটন দাদু, কুট্টি মামা একমাত্র প্রবেশের অধিকার পেয়েছিলাম। ধোওয়া জামা প্যান্ট পরার পর চরণামৃত তিনি আমাদের শরীরে ছিটিয়ে দিতেন। ছড়িয়ে দিলেই আমরা পুণ্যবান হয়ে যেতাম। পঞ্চপ্রদীপ জ্বালাতে পারতাম। ধুনুচিতে নারকেলের ছোবড়ায় আগুন দিতে পারতাম। এবং কো-কুশি এগিয়ে দেবারও অনুমতি মিলে যেত।
অধিরথ দাদুর কথামতো পাঁচিলের গেট থেকে নিশ্বাস বন্ধ করে থান থেকে ফুল বেলপাতা তুলে এনেছিলাম। বিশাল এক অরণ্যের ভিতর দিয়ে পথ। বড়ো বড়ো শাল জারুল এবং বট বৃক্ষের ভিতর অরণ্যটি সব সময় ভীতির উদ্রেক করে। একা এই পথ ধরে কখনো নদীর পাড়ে আসতে সাহস পেতাম না। বনজঙ্গলের ভিতর ঢুকে অধিরথ দাদুকে বলেছিলাম, জামা-প্যান্ট দাও। আমার লজ্জা করছে।
অধিরথ দাদু হেসে বলেছিলেন, এতটুকুন ছেলের কিসের লজ্জা!
বোঝাই কী করে নির্জন মন্দিরের সামনে উলঙ্গ হয়ে ফুল বেলপাতা তুলে আনা একরকমের, আর বাড়ির ভিতর উলঙ্গ হয়ে ঢাকা অন্য রকমের। মা মাসির, গাঁয়ের অন্য নাবালিকার ভিড়ের মধ্যে উলঙ্গ থাকতে কার না লজ্জা হয়! অধিরথ দাদু মুচকি হাসছিলেন।
সবচেয়ে ভয় কুট্টি মাসিকে। আমাকে উলঙ্গ দেখলেই গোপনে শাসাবে, তুই কি মানুষ! না পাঁঠা। আমি মুখ ব্যাজার করে ফেললে ঠিক বলবে, আসলে তুই অপদেবতা। ওঝা বদ্যির বশ। তোর কী দোষ!
কুট্টি মাসি আমার সুখদুঃখ টের পায় খুব। কারণ মামাবাড়ি গেলে, কুটি মাসির অজস্র ফুটফরমাস খাটতে হত।
এই সেমিজটা দে।
খালি গা। সুপরি ওঠার মতো স্তন। আমার কোনো বিকার সৃষ্টি হয়নি। সেবারে মাতামহীর সূতিকা গৃহে সাঁঝ লাগার সঙ্গে মা স্নান সেরে ঢুকে যেত। ঢুকে যাবার আগে দরজার সামনে একটি অগ্নিকুণ্ড সৃষ্টি করা হত। মাতামহ অগ্নিকুণ্ডের পাশে বসে বটুক ভৈরব স্তোত্র পাঠ করতেন। মা সূতিকা গৃহে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিতেন। ভিতরেও থাকত একটি অগ্নিকুণ্ড। দিবানিশি গাছের গুঁড়ি পুড়ছে। সকালে মাতামহী কালোজিরে বাটা আর ঘি দিয়ে অগ্নিকুণ্ডের দিকে পিঠ রেখে খেতে বসতেন। কোনায় ছেড়া কাপড়ের মধ্যে মাংসের ডেলার মতো পড়ে আছে শিশুটি। হাত পা নাড়ছে, কখনো গগন ফাটিয়ে আর্তনাদ। মাতামহী সঙ্গে সঙ্গে বুকে তুলে বিশাল স্তনে সন্তানের মুখ ঠেসে ধরতেন। মা সূতিকা গৃহে ঢুকে গেলে আমি একা। কুট্টি মাসি তখন আমার সব। আমার সঙ্গী। এক সঙ্গে খাওয়া, এক সঙ্গে ঘাটলায় গিয়ে বসে থাকা, গাছ থেকে চাঁপা ফুল পেড়ে আনা—সব। এবং শোওয়ার সময় তার পালঙ্কে আর একটা বালিশ রেখে বলত, কীরে ভয় পাবি না তো! ভয় কী। তোর মা নেই, আমি তো আছি। তখন আমার মনেই হত না কুট্টি মাসি আমার চেয়ে দু-তিন বছরের বড়। এমনকী পড়াশোনার কথাও বলতেন। অঙ্কগুলো করেছিস। তোর ছটির পড়া কখন করবি? টেবিলে সেজবাতি জ্বালিয়ে আমার পাঠ্য বই-এর সামনে ঝুঁকে বসতেন। আমি গেলে, মা গেলে যে কোনো কারণেই হোক কিছুটা স্বাভাবিক থাকতেন। বাড়ির আমসত্ত্ব, নাড়, সন্দেশ আমাকে চুরি করে খাওয়াতে ভালোভাসতেন। এ-জন্য হতে পারে, কিংবা কুট্টি মাসির শরীরের কোনো হেতু থেকেও হতে পারে। আমি প্রায় তাঁর কাছ ছাড়া হতাম না।