আমার মাও বোধ হয় গর্ভধারিণীর গর্ভধারণে সংকোচ বোধ করতেন। আগে শুনেছি গুম মেরে যেতেন। ঠাকুমা টের পেয়ে বলতেন, মেজো বউমার শরীর বোধ হয় ভাল নেই। কিংবা বলতেন, বাপের বাড়ি থেকে কী দুঃসংবাদ এল কে জানে! বড়ো জেঠির তত্ত্বতালাশ শুরু হয়ে যেত এবং ক্রমে জ্যাঠামশাইর কানে কথাটা উঠলে বাহার চাচাকে দিয়ে ডুলিতে মাকে পাঠিয়ে দিতেন। আমাদের গাঁয়ের ছাড়া বাড়িতে সাত-আটজন লোক পালকি নিয়ে শীত গ্রীষ্ম বসবাস করত। বর্ষাকাল এলে সুদূর মুঙ্গের বলে একটি দেশ আছে সেখানে চলে যেত। গাঁটাগোট্টা মোটা গোঁফ, বেঁটে মতো লোকগুলি মুঙ্গেরের মানুষ খুব অচেনা জায়গা নয়—কারণ বই এ তখনকার দিনে মুঙ্গেরের ভূমিকম্প কথাটা লেখা হয়ে গেছিল। আমরা স্কুলের পাঠ্য বই থেকে মুঙ্গের নামক স্থানটির পরিচিতি লাভ করে ফেলেছি। লোকগুলিকে চিনতে অসুবিধা হত না। ওদের দেশোয়ালি ভাষা আমরা একদম বুঝতাম না। তবে ভাঙা বাংলা বলতে পারত বলে রক্ষা। ডুলি কাঁধে যাবার সময় আমি আর বাহার চাচা অনেক পেছনে পড়ে থাকতাম। তারা মাঠ পার হয়ে খাল নদী বিল পার হয়ে কোনো গাছতলায় অপেক্ষা করত। আমরা গাছতলায় পৌঁছালে আবার তারা রওনা দিত। মা শুধু একবার ডুলির কাপড় তুলে মুখ বার করে আমাকে দেখে নিশ্চিন্ত হতে পারতেন।
বর্ষায় কোনো অসুবিধা ছিল না। ঘাট থেকে নৌকা ছেড়ে দিলেই হল। পাল তুলে দিলেই হল। বর্ষার জল থই থই করছে। আমি আর মা ছই-এর ভিতর। কাঠের পাটাতনে সাদা ফরাস পাতা বিছানা। দুদিকে কাঠের দরজা। দরজা খুলে প্রায়ই আমি বাইরে এসে বসতাম। বাহার চাচা তামাক খেতে খেতে আমার মাতামহের যশ করতেন খুব। সাচ্চা আদমি বলতেন মাতামহকে। আমি গর্ব বোধ করতাম।
এমন একজন মাতামহের প্রতি কুট্টি মাসি খুব রুষ্ট ছিলেন ধরতে পারতাম। মাতামহকে সহ্য করতে পারতেন না। তাঁর কী অপরাধ তাও ধরতে পারতাম না। কথায় কথায় কুট্টি মাসি বলত, যাব যেদিকে দু-চোখ যায় বের হয়ে?
আমি বলতাম, যাও না কেন?
যাব কী করে। দেখিস না, কুকুরগুলি কী জ্বালায়।
তা হলে একমাত্র কুকুরের ভয়ে কুট্টি মাসি দেশান্তরী হতে পারছেন না। কুকুরের উপদ্রব নেই কোথায়! এমন জায়গা আমারও চেনা নেই যে বলি, কুট্টি মাসি, আমি চিনি, যাবে! কুকুরের উপদ্রবে পড়তে হবে না এও ভেবে পাই না, জোড়া কুকুর দেখলেই মাসি এত খেপে যায় কেন। এক কথা, মার মার। লাঠি পাচ্ছিস না! বলে কোত্থেকে একটা বাঁশের লাঠি দিয়ে বলত, ঠেঙা। হাত-পা নুলো করে দে। কী রে দাঁড়িয়ে থাকলি কেন!
কামড়াবে মাসি।
দে আমাকে। বলে লাঠি নিয়ে উন্মাদের মতো ছুটে যেতেন। অধিরথ দাদু দেখলে ছুটে যেত। বলত আবার মাথা খারাপ হয়েছে দেখছি। ইস করছেন কী কুট্টি মাসি। মরে যাবে যে। কুকুরগুলিও বেহায়া আবার ঠিক কুট্টি মাসির জানালায় এসে দাঁড়িয়ে থাকবে। একবার এক জোড়া কুকুরের পেছনে তাড়া করতে গিয়ে আমি আর ছোটন দাদু সেই ভূতুড়ে দেশটায় গিয়ে পড়েছিলাম। নদীর পাড়ে শ্মশান, চালাঘর, তার পাশে আঁশশ্যাওড়ার জঙ্গল—নানারকমের ঢিবি। জায়গাটায় গেলেই গা ছমছম করত। কারণ এ-জায়গাটা কোনো রাক্ষসের রাজত্ব মনে হত। আমি, মাতামহ, ছোটন দাদু, কুট্টি মামা এর আগেও দুবার এসেছিলাম জায়গাটায়। ছোটন দাদুর মাথায় হাঁড়ি। কুট্টি মামার কাঁধে কোদাল। মাতামহের কোলে মৃত শিশু। শিশুটি আমার মাসি হতে পারত। ছোটো ছোটো দুটো নীলচে পা কাঁথার ফাঁকে বের হয়ে আছে। আমরা তাকে জঙ্গলে পুঁতে রাখব বলে যাচ্ছিলাম। আমার হাতে কিংবা মাথায় কিছু ছিল না। না গেলেও চলত। ভয়ে আমি কুট্টি মাসির ঘরে পালিয়েছিলাম। বার বার ডাকছেন মাতামহ, দিবানাথ, দিবানাথ! তারপরে তেতে উঠেছিলেন, পুংগির ভাই গেল কোথায়! সাড়া পাচ্ছি না! মাতামহীর শোকার্ত চিৎকারের মধ্যেও তিনি নির্বিকার। পরিহাসচ্ছলে যেকথা বলে থাকেন, আমাকে সেদিন খোঁজাখুঁজির সময় সেই বাক্য উচ্চারণ। মারও ইচ্ছা নয় এমন শবযাত্রায় আমি সঙ্গী হই। তিনি জানতেন, কার ঘরে আমি আশ্রয় নিতে পারি। জেনেও চুপ করেছিলেন। ভয়ডর বলে কথা। অথচ মাতামহের ইচ্ছের বিরুদ্ধে তিনি কিছু বলারও সাহস রাখেন না।
উঠানে তিনি এবং প্রতিবেশীরা।-অধিরথ দাদু কোদাল নিতে পারতেন, হাঁড়িও। আমাদের কারও যাওয়ারই দরকার পড়ে না। কিন্তু বামুনের মড়া, চুলে জাত যাবে—এবং শুদ্ধাচারী মানুষের বাড়ি বলে সবাই তটস্থ। ছোঁয়াছুঁয়ি হয়ে না যায়। একপাশে আলগাভাবে দাঁড়িয়ে আছেন। আর ডাকছিলেন, দিবানাথ তোমার সঙ্গে যাওয়া দরকার। প্রকৃতি কাউকে ক্ষমা করে না। তুমি সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছ। তুমি বুঝতে পারছি আতঙ্কগ্রস্ত। কোথায় পালিয়ে আছ জবাব দাও।
লম্বা বারান্দা পার হয়ে অন্দরমহল। সেখান থেকে আর্ত কান্না ভেসে আসছে, বাবারে কোথায় গেলি রে। আমার কী হবে রে। আমার সোনার চাঁদকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ। শোকার্ত মাতামহী বাবা বলে কেন আর্তনাদ করতেন আমার কাছে বিস্ময়। মা বারান্দা ধরে নীচে নেমে বলেছিলেন, দিবানাথের শরীর ভালো নেই বাবা।
সে কোথায়!
কুসুমের ঘরে।
কুট্টি মাসির নাম কুসুম।
ফুলের নামে সবার নাম। কেবল কুট্টি মাসির নাম কুসুম। মা-র নাম নিতে হয়, ছেলেবেলায় এই শিক্ষা পাওয়ার দরুন বুঝি ফুলের সঙ্গে মেয়েদের নামের কোথাও একটা মিল থেকে গেছে। মাতামহীর প্রতিমার মতো মুখ মেয়েরাও পেয়েছে। এত ঘন চুল, আর ছবির মতো ঘরবাড়ি মিলে, বাড়িটা অঙ্গরা।