ঈষৎ ব্যাখ্যা করে সঞ্চারী সব তার মাকে বলতেই, কৃষ্ণ লাফিয়ে উঠল। ও তাই, আচ্ছা। দরজায় উঁকি দিয়ে বলল, আপনি ভাই ভিতরে এসে বসুন। মণি পাঠিয়েছে, কাল এসে ফিরে গেছেন, পুজোর বাজার!
সোফায় ঢাউস ব্যাগটা তুলে নিয়ে কথাটা বলল কৃষ্ণ।
বসুন। মণির বাড়িতে কবে লাগালেন! মণিকে বলেছিলাম।
বসার ঘরটা একটু বেশি মাত্রাতেই বড়ো। একদিকে সোফাসেট, কোনায় টিভি, বাঁদিকে লম্বা বই-এর র্যাক, পাশে পর পর দুটো বড় কোম্পানির ক্যালেন্ডার এবং দেয়ালে লাঠি হাতে সেই চিরাচরিত ভঙ্গিতে চার্লি চ্যাপলিন। ঘরের আর একদিকে একজনের শোওয়ার মতো তক্তপোষ। দামি বেডকভারে ঢাকা একটা পাশবালিশের সাদা রঙের ঢাকনায় রেশমি সুতোর কিছু নকশা। ঘরের তুলনায় জানালাগুলি ছোটো, নেট দেওয়া নীল রঙের নাইলেন, মশার উৎপাত আছে।
সঞ্চারী এখন খুবই হালকা। মা এসে গেছে। তার আর কোনো কর্তব্য নেই। সে নিজের ঘরে ঢুকে আয়নায় দাঁড়াল। চুলে কাঁকুই চালাল। কাঁধের আধ-শুকনো তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে সামান্য প্রসাধন করল। গোল করে কপালে সুন্দর সবুজ রঙের একটা টিপ পরল। তারপর উরুর কাছটায় ভিজে মনে হওয়ায় লম্বা ফ্রক তুলে বাঁপাটা খাটে রেখে ভিজে জায়গা মুছে দিতেই, মায়ের কণ্ঠস্বর কী রে এসে কিছু খেয়েছিস। শুভদা কিছু করে রেখে গেছে।
কী জানি, দেখিনি।
খেয়েছিস?
না। বাথরুমে মা-র যে বেশি সময় লাগে না, সঞ্চারী ভালোই জানে। তার প্রসাধনের ফাঁকে মা-র সব কাজ সারা। চাও বসিয়ে দিয়েছে। পাউরুটি স্যাঁকা, স্যালাড় কেটে রাখা, ডিমের ওমলেট সবই তৈরি। মা এত কাজের, কে বলবে ভিড়ের বাস ঠেঙিয়ে বাড়ি ফিরেছে। বাবাও বোধহয় এসে যাবেন। তা ছাড়া পে কমিশনের লড়ালড়িও আর নেই। সংগঠিত শ্রমিক শ্রেণীর লড়াকু নেতা এখন নিশ্চিন্ত। পুজোর সময়, আত্মীয়স্বজনদের ভিড় থাকেই। কেউ না কেউ রাতে আসে। বাবা বাড়ি না থাকলে তারা যেন হই হুল্লোড়ে মেতে উঠতে পারে না। মামারা তো ভগ্নিপতিটির নামে পাগল। এই হই হুল্লোড়, কখনো তার ভালো লাগে, কখনো লাগে না। আসলে সবাই কাজে কামে ব্যস্ত, অফিস আর ইনক্রিমেন্ট পদোন্নতির কথাও থাকে, এই একটা জগৎ, কোম্পানির কথা, রেলের কথা, এবং বাজারদর, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, কোথায় কে পূজার ছুটিতে বেড়াতে যাচ্ছে, কোন কোম্পানির হলিডে হোম, কী সুযোগ-সুবিধা বিস্তারিত তার বর্ণনা। তারাও যায়, বাবার রেলের এ-সি পাস, তাদেরও। সে তো গত পুজোয় দেরাদুন থেকে দিল্লি ফেরার পথে পুরো ছশো টাকা শুধু কোল্ড ড্রিংকসের পিছনেই উজাড় করে দিয়েছিল। আসলে কিছুটা রাগ ক্ষোভ, তার কিছুই হচ্ছে না, সবাই দারুণ সুখী, মা
বাবা দিদি, সবার আর্থিক সঙ্গতি প্রবল, প্রিভিলেজজ ক্লাস। সে সেবারে বাবার কাছ থেকে ছশো টাকা নিয়ে বাবাকেই ফতুর করে দিতে চেয়েছিল। সবাই মিলে তাকে ডিক্লাসড করে রেখেছে—সে ছাড়বে কেন?
তার কত স্বপ্ন, এম এস-সি, থিসিস, স্লেট নেট—সবই ভোকাট্টা। পার্ট টুর প্র্যাক্টিক্যাল তাকে ডুবিয়েছে। পার্ট ওয়ানে এখন ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট, মা তো খুশি হয়ে বাড়িতে বিশাল গেট টুগেদারে মত্ত হয়ে গেছিল। মা তার কলিগদের, বাবা তার অফিসের বন্ধুদের, আত্মীয়স্বজনরা তো আছেনই, তারপর…তারপর কী!
না, সে আর ভাবতে পারে না। প্র্যাক্টিক্যাল পরীক্ষার আগেই অসুস্থ। ছোঁয়াচে রোগ, সারা শরীরে গুটিপোকার মতো জল নিয়ে ফোসকা, কী ব্যথা, আর জ্বর, জ্বরে তারপর বিছানায় শয্যাশায়ী, প্রাক্টিক্যাল পরীক্ষার সময় আলাদা সিটে আলাদা ব্যবস্থা। সে অচ্ছুত হয়ে গেল। অদ্ভুত জীবনের শুরু। কোথাও ঢোকার জায়গা নেই। তার জন্য সর্বত্র নো এনট্রি।
আবার ডোর বেল বাজল।
এই সঞ্চারী, দ্যাখ তোর বাবা বোধহয় এল।
সঞ্চারী বসার ঘরে ঢুকে দরজা খুলে দিল। বাড়িটায় যেই আসে, সামনের বারান্দায় উঠে বেল টিপে দেয়। পেছনে সিঁড়ির পাশের দরজাটা এ-জন্য প্রায় খোলাই হয় না। পেছনের দরজায় এসে ডাকলে, তাকে বসার ঘরে ঢুকতে হয় না। লোকটা দারুণ ভালো মানুষের মুখ নিয়ে বসে আছে। তার দিকে চোখ তুলেও তাকাচ্ছে না। অবশ্য সে জানে লোকটা সবই তার দেখছে, এমনকী তার শরীরের সব ভাঁজগুলো পর্যন্ত। পুরুষ তো নারী-শরীরের অন্তর্যামী। তাদের কাছে কিছুই আড়াল করা যায় না। দামি পোশাকে শরীর ঢেকে রাখার চেষ্টা খুবই হাস্যকর, এটা সে ভালোই টের পায়। আলোর মতো তাপও অদৃশ্য এবং তরঙ্গগামী। উৎস থেকে তরঙ্গের আকারে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সঞ্চারিত হয়। যে-ভাবে তাকে আড়ালে দেখছিল!
সঞ্চারী-ই…।
কেউ যেন দূরে ডাকে।
কে ডাকে! সে বালিকা বয়স থেকেই এই ডাক শুনতে পায়। সে জানা গায়ে দেয়, প্যান্টি খুলে ফেলে, মোজা পরে, পারে জুতো গলায়, এবং সে বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে থাকলে, এই অধীর অচেনা কণ্ঠস্বরে সে বিচলিত বোধ করে। কেউ তাকে ডাকে, বড়ো হতে বলে। সে মাঝে মাঝে বড়ো হবার জন্য আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে—এবং কিছু আভাস শরীরে ফুটে উঠতে থাকলে, সে বোঝে এরই নাম বড়ো হওয়া। প্রকৃতির অমোঘ ইচ্ছে শরীরে কারুকার্য তৈরি করছে। প্রকৃতির কূট কামড়ে সে এখন বিছানায় শুয়ে প্রায়ই সেই রহস্যময় পুরুষকে খুঁজে বেড়ায়।