রথতলার মাঠে বিশাল একটি বকুল বৃক্ষ। এটি কে রোপণ করেছিলেন, কিংবা অবহেলায় বেড়ে উঠেছিল কি না আমাদের জানা নেই। কালো কালো ডাল, অজস্র শাখাপ্রশাখায় জায়গাটা দিনের বেলাতেও অন্ধকার হয়ে থাকে। দূরের পথিকরা গাছের গোড়ায় খর রোদ থেকে বাঁচার জন্য দু-দণ্ড জিরিয়ে নেয়। মাতামহের বাড়ি থেকে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে একটা পথ আছে। অন্দরমহল থেকেও সেই পথ ধরে এই বকুল বৃক্ষের তলায় আসা যায়। আমার কুট্টি মাসি বকুল ফল এবং ফুল দুই ভালোবাসে। আমার সঙ্গে কুট্টি মাসি মাঝে মাঝে বকুল ফুল তোলার জন্য গাছটার নীচে এসে দাঁড়াত। ফুল এত অজস্র যে বর্ষার প্যাঁচপ্যাঁচে ফুলের গন্ধ। কাদা থেকে ফুল তোলা যেত না। আমরা গাছের শাখাপ্রশাখায় নজর রাখতাম। ফুল এসে মাটিতে পড়ার আগেই ধরে ফেলতাম। মাটিতে পড়লে কাদা লাগবে ভয়ে এটা করা হত। কিংবা গ্রীষ্মের দাবদাহে ফুলের ওড়াউড়ি কেমন নেশা ধরিয়ে দিত কুট্টি মাসিকে।
বিকেল বেলাতে কুট্টি মাসির সাঁকো পারপারের খেলা শুরু। আমরা সমবয়সীরা তার সঙ্গী। তার কথামতো না চললে, দুপদাপ পা ফেলে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে ছুটে পালাত। তারপর সত্যি-মিথ্যা নালিশ তার। এবং অকপটে এমন মুখ ব্যাজার করে নালিশ দিত যে আমরা শুনে আহাম্মক বনে যেতাম।
সাঁকো পারাপারের নেশা আমার কম না। আগে কুট্টি মাসি সাঁকোর ওপর উঠে টলতে টলতে হাঁটত। হাতলের বাঁশ না ধরে হাঁটত। প্রায় পৌঁছে যাচ্ছে। আমরা সাঁকোর গোড়ায় দাঁড়িয়ে। আমরা পারি না, কারণ বিকেল থেকেই খেলার শুরু। কেউ কিছুটা গিয়ে, কেউ মাঝপথে হাতলের বাঁশ ধরে ফেলি। কুট্টি মাসি বিনা অবলম্বনে টলতে টলতে পার হয়ে যাচ্ছে, এটা আমার সহ্য হত না। আমি সাঁকো ঝাঁকিয়ে দিতাম। সঙ্গে সঙ্গে কুট্টি মাসি আত্মরক্ষার্থে হাতলের বাঁশ ধরে ফেলত। না ধরলে বিশ-বাইশ ফুট গভীরে জলে কাদায়, কচুরিপানায় ডোবাডুবির কেলেঙ্কারি।
কে ঝাঁকাল।
এক কথা, না আমরা ঝাঁকাইনি।
মিথুক। বলেই কান ধরে টানাটানি করতে এলে বলতাম, মাসি কুকুর। ব্যা
স হয়ে গেল। রাস্তায় জোড়া কুকুর দেখলেই মাসির মাথা খারাপ।
তাড়া তাড়া।
ঢিল নিয়ে ছুটছি। কুকুর দুটোকে তাড়িয়ে না দিতে পারলে, চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য করে দিতে না পারলে বাড়ির সবার ভোগান্তি। শুয়ে থাকবে মাসি। খেতে বসলেই ওক উঠবে।
শ্রাবণ-ভাদ্রে কুট্টি মাসির জোড়া কুকুরের ভয় এত যে তার ঘরের দক্ষিণের জানালা বন্ধ রাখতে হয়। কারণ জানালা খুললে লিচু বাগান এবং হাটের দোকানপাট সহ রাস্তা ভেসে ওঠে এবং জোড়া কুকুরও। জানালাটা শ্রাবণ-ভাদ্রে এ-জন্য বন্ধ করে রাখা হয়। আমার কুট্টি মাসি ফ্রক ছেড়ে শাড়ি পরার পর থেকেই এটা হয়েছে। ন-মাসি ফ্রক পরে। আমার ছোটো। অন্না মাসি তারও ছোটো। মামা মাসি মিলে বারো তেরোজন। শুধু বারো বলতে পারি না, আবার তেরোও বলতে পারি না। বারো বললে মিছে কথা হযে, তেরো বললেও মিছে কথা হবে। কারণ মাতামহীর গর্ভের সন্তানটিকে বাদ দিলে বাক্যের অপলাপ হবে।
মাতামহ তান্ত্রিক মানুষ। মাথায় বিশাল শিখা। সকাল বেলায় প্রাতঃস্নান, স্তোত্র পাঠ। বর্ষায় নদীর ঘাটলায় অবগাহন—সূর্য প্রণাম থেকে কালী কবচ পাঠ-হাতে এক ঘটি জল নিয়ে মঠের শিবের মাথায়, কালীমন্দিরের চার করবী গাছে এবং ধুতুরার জঙ্গলে জল ছিটিয়ে বাড়ি ফেরেন। গরদের কাপড় পরনে। ঘরে তাঁর পাঁজিপুঁথি, দূর দূর গ্রাম থেকে শ্রাদ্ধ, অশৌচ, পাকা দেখা বেং অন্যান্য শুভ দিন, যাত্রা শুভ না অশুভের ভিড়। মূল প্রাসাদের বাইরে বিশাল উঠান। বড়ো বড়ো গোলা, ধানের, মুসুরির, মুগের। তার সংলগ্ন ভেঁকিশালা। অধিরথ দাদুর তত্ত্বাবধানে সব। পাঁঠা বলি থেকে, জমিজমা চাষ আবাদ দেখার দায় তার।
কাকভোরে খড়ম পায়ে মাতামহ তার ঘর থেকে বের হলে হৃৎকম্প দেখা দিত আমাদের। উচু লম্বা এবং এত ফর্সা যে রক্তচন্দনের প্রলেপ চকচক করত কপালে। শিখাতে একটি লাল জবা দোদুল্যমান। গ্রামটা বিশাল, সাহা, পাল, ধোপা, নাপিত, বাদ্যকার এবং আচার্য ব্রাক্ষণ বলতে এক ঘর—আর বাদবাকি জেলেপাড়ার বাসিন্দা। ব্রাহ্মণ পরিবার বলতে আমার মাতামহ এবং তাঁর পরিবার। পরিবারের নানাবিধ লোক মিলিয়ে ত্রিশ একত্রিশ। মামা বলতে কুট্টি মামা। আর সব মাসি। পাঁচ মাসির বিয়ে হয়ে যাওয়ায় পরিবারের জনসমষ্টি কিছুটা ভাটার দিকে। কুট্টি মাসির সম্বন্ধ আসছে। পছন্দ হচ্ছে না। কারণ পাত্রপক্ষ কী করে খবর পেয়ে যায় মাসির মাঝে মাঝে মাথা খারাপ হয়ে যায়। অস্বাভাবিক আচরণ। খাওয়া-নাওয়া বন্ধ। খেতে বসলে বমি পায়।
শ্রাবণ ভাদ্রে রোগের লক্ষণ প্রকাশ। শীত এলে নিরাময়। এছাড়াও এই রোগের প্রকোপ বাড়ে মাতামহীর গর্ভধারণে। কারণ, গর্ভধারণের শেষ দিকে আমার মাকে আসতেই হয়। মাতামহীর সেই চিঠির কথা আগেই বলেছি—একবার চিঠিটি দেখেই বুঝেছিলাম, বার বার এই একই বার্তা থাকে, তোমার গর্ভধারিণী আবার গর্ভধারণ করেছেন। তুমি কাছে থাকলে তিনি মনে বল পান। বড়ো পুত্রার অনুমতি সাপেক্ষে তোমার আসা বাঞ্ছনীয়।
বড়ো পুত্রার অনুমতি সাপেক্ষে অর্থাৎ আমার বড়ো জ্যাঠামশাইর অনুমতি নিয়ে যাত্রা করার নির্দেশ থাকত চিঠিতে। আগে শুনেছি, মাতামহ মাকে চিঠি দিতেন না। বাবা প্রবাসে থাকেন, তাঁকে চিঠি দেবার প্রশ্নই নেই। গৃহকর্তা বর্তমানে বড়ো জ্যাঠামশাই। ঠাকুরদা বেঁচে থাকতে তাঁর কাছেই চিঠি দিতেন। সবই শোনা কথা।