মামার বাড়ি যেতাম মা-র সঙ্গে। শীতে গ্রীষ্মে কখনো বর্ষায় মাতামহের চিঠি আসত। মাতামহের সেই গোপনীয় চিঠি একবার দেখে ফেলেছিলাম। মা এই চিঠি এলেই আড়ালে কাঁদতে বসতেন। চিঠিটাতে কী এমন দুঃসংবাদ থাকত, জানি না। বড় জ্যাঠামশায় তখন বৈঠকখানা ঘর থেকে খড়ম পায়ে বের হয়ে ডাকতেন, বাহার, বাহার আছিস!
বাহার চাচার সাড়া পাওয়া যেত গোয়ালঘরের পেছনে। বলত, যাই কর্তা।
বাহার চাচাকে তিনি বলতেন, মেজবউ কান্নাকাটি করছে। বাপের বাড়ি যাবে বলছে। দিয়ে আয়। দিনক্ষণ দেখে দিচ্ছি।
ব্যাস, আমার তখন মজা। কারণ মামার বাড়ি গেলেই সাঁকো পারাপারের খেলা শুরু হয়ে যাবে। এই এক মজা যেমন আমাকে তাড়া করত, সঙ্গে এক আতঙ্কও ছিল গভীর। মুখ ব্যাজার হয়ে যেত সেসব দৃশ্যের কথা মনে হলে।
যেমন, মাতামহের চিঠিতে লেখা থাকত, তোমার গর্ভধারিণী আবার গর্ভবতী। এই গর্ভবতী শব্দ মাকে কিছুটা বোধ হয় ত্রাসের মধ্যে ফেলে দিত। চিঠিটা পড়েছি জানতে পেরে, মা একবার খুব মেরেছিলেন আমাকে।
মা, দিদিমার দ্বাদশ বর্ষের প্রথম সন্তান। আমি মা-র পঞ্চদশ বর্ষের একমাত্র জাতক। আমার বয়স তখন আট-দশ হতে পারে, কিংবা দশ-বারো হতে পারে–সে যাই হোক, দিদিমা যে যুবতী সে বয়সেও টের পেতাম। একটা চুল পাকেনি। চোখ বড়ো বড়ো–প্রতিমার মতো মুখ। মায়ের রং আশ্চর্য রকমের লাবণ্যে ভরা। কুট্টিমাসি, আমার বছর দু-তিনের বড়। ছোটন দাদু মা-র কনিষ্ঠ খুড়ামশাই। আমার মা-র চেয়ে আট-দশ বছরের ছোটো।
তবু মা তাকে আপনি আজ্ঞে করতেন। মামার বাড়ি গেলে প্রণামের ধুম পড়ে যেত। মা-র একমাত্র সন্তান বলে আমাকে ছেড়ে তিনি কোথাও এক রাত কাটাতে পারতেন না। আমার মাতামহের পিতৃদেব দ্বিতীয়বার দ্বার পরিগ্রহ করেন। ছোটন দাদু তার দ্বিতীয় পত্নীর সন্তান। মাতামহের পিতৃদেবকে আমি দেখিনি। বাড়ির বৈঠকখানায় তাঁর একটি তৈলচিত্র আছে। খড়ম পায়, দীর্ঘকায় সুপুরুষ, খালি গায়ে কোঁচানো ধুতি পরে দাঁড়িয়ে আছেন। সাদা গোঁফ, চোখে চশমা, গলায় সাদা ধবধবে উপবীত। মাথায় লম্বা শিখাঁটি পর্যন্ত ছবিতে ধরা আছে। চোখ বিস্ফারিত, সাদা মারবেল পাথর বসানো চোখে এবং তাতে মনে হত দুটো বেতুন ফল বসানো আছে। তৈলচিত্রটির সামনে যেতে আমার ত্রাস সৃষ্টি হত কেন জানি না। কাছে গিয়ে দাঁড়াবার সাহস হয়নি। তেজস্বী চেহারা, গম্ভীর এবং গর্জন তেলের মতো চকচকে।
আর সবচেয়ে বিস্ময় সৃষ্টি করত, হাতে তাঁর এক গণ্ডা অতিকায় ইলিশ। শিল্পী এই ইলিশ কেন হাতে রেখেছেন জানি না। গাঁয়ের কুলদা আচার্য ছবিটি এঁকেছিলেন। মা কথায় কথায় এমন বলতেন। এত দাপট ছিল তাঁর বাঘে গোরুতে এক ঘাটে জল খেত। তিনি মেঘনার ইলিশ পছন্দ করতেন। গাঁয়ের রথতলায় তিনি হাট বসিয়েছিলেন যাতে মেঘনা থেকে জেলেরা সোজা হাটে চলে আসতে পারে। হাটে তিনি যেতেন, সবচেয়ে বড়ো এবং তাজা এক গণ্ডা ইলিশ কিনবেন বলে। গৃহভৃত্য সঙ্গে থাকলেও তিনি নিজে হাতে ঝুলিয়ে ইলিশ আনতেন। হয়তো কুলদা আচার্যের কাছে এই দৃশ্যটাই বড়ো গুরুত্ব পেয়েছিল। মানুষটিকে বুঝতে হলে, এক গণ্ডা ইলিশ হাতে ঝোলানো রাখা দরকার তিনি হয়তো এমন ভেবেছিলেন—গুরু বংশ বলে কথা! আমার সব সময়ই মনে হয়েছে মাতামহের পিতৃদেব কাজটি ভালো করেননি। তাঁর আঠারোটি সন্তান এবং জীবিত অবস্থায় যোলোটি সন্তানের দাহকার্য সম্পন্ন করেছেন। দুই স্ত্রী গত হয়েছিলেন। আমার মাতামহ এবং ছোটন দাদুকে ছাড়া শেষ বয়সে তাঁর আর কেউ ছিল না। পিতার অসম্পূর্ণ কাজটি মাতামহ শুরু করে দিতেই তিনি নিশ্চিন্তে দেহত্যাগ করতে পেরেছেন এমন মনে হত আমার।
তিনি যে বিশাল বিত্তের অধিকারী, তাঁর চিহ্ন রথতলায় মঠ, প্রাসাদতুল্য বাড়ি, সামনে সবুজ ঘাসের লন, ঘাটলা বাঁধানো দিঘি—এবং নদীর পাশে এক বিশাল অরণ্য। বৈঠকখানায় মেহগিনি কাঠের চেয়ার, শ্বেতপাথরের টেবিল, পালঙ্ক তাকিয়ার ঠেস দিয়ে অম্বুরি তামাকের ধোঁয়া গিলে চোখ বুজে বিত্ত-বৈভবের কথা হয়তো ভাবতেন, এ-হেন দৃশ্যেরও দু-একটা ছোটোমাপের তৈলচিত্র আঁকিয়ে রেখেছিলেন।
তিনি একটি কালীবাড়িও প্রতিষ্ঠা করে যান। ধুতুরা ফুলটি এবং চারটি করবী গাছ নিজ হাতে রোপণ করেন। কালীবাড়িটি বিশাল জঙ্গলের মধ্যে। বর্তমানে আমার মাতামহ সেবাইত। জাগ্রত দেবী তিনি। শনি মঙ্গলবারে জোড়া পাঁঠা বলি, তার পূজা হোম লেগেই থাকে। পাশেই নদী। ছাগল বামনি। বোধহয় মেঘনার খাড়ি নদী এটা-মেঘনা থেকে বের হয়ে মাতামহের গাঁয়ের পাশ দিয়ে বিশ-বাইশ ক্রোশ দূরের শীতলক্ষ্যায় গিয়ে মিশেছে। সাঁকোটা তারই ওপর। বাঁশের সাঁকো। বর্ষায় নদী হয়ে যায়। জলের খরস্রোতে সাঁকোটি ভেসেও যায়। বর্ষার শেষে নদী শীর্ণ হতে হতে যখন দু-পাড় খুবই কাছে এসে যায়, সাঁকোটি তৈরি হয়। বাঁশের সাঁকো। নীচে দুটো করে বাঁশ ফেলা থাকে। নদীতে আট-দশ গজ অন্তর বাঁশের খুঁটি পুঁতে দেওয়া হয়। এভাবে সাঁকোটি উপরের দিকে কিছুটা উঠে গিয়ে ফের নীচের দিকে নামতে শুরু করে। পঞ্চাশ ষাট গজ, কি তারও বেশি হতে পারে সাঁকোর পাশে লম্বা বাঁশ টেনে দেওয়া—নদী পারাপারের জন্য। বাঁশ ধরে সন্তর্পণে হেঁটে যেতে হয়। খুঁটি নড়ে। বেশ ঝাঁকুনি খায়, অথচ হুমড়ি খেয়ে পড়ে না। আট দশজন লোক পারাপার হয় একসঙ্গে।