কনকে অন্য সময় হলে কড়া ধমক দিতে পারত। কিন্তু ওর মা তো ঘুমোচ্ছে। ওর মা সোনার কৌটা খুলে শুয়ে আছে। সে পাপুর সঙ্গে মিছে কথা বলছে মা ঘুমোচ্ছে, আস্তে কথা বল। সবটাই বানানো—নিজের দুর্বলতা টের পেয়ে কনকে কেমন ছেলের সামনে অসহায় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকল। এবং নিজের মধ্যে যেন কোনো অনুশোচনা, অনুতাপ—সন্তানকে এত ছোটো বয়েস থেকে আলগা করে দিলে বোধ হয় ব্যবধানটা খুব তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে যায়। সে দেখল মা, ঝুমকিকে নিজের খাটে তুলে নিচ্ছে তখন। তার দিকে তাকিয়ে মা বলছে, ঠিক আছে, ঝুমকি আমার সঙ্গে শোবে।
মার সাদা বিছানা, মার শরীরে সাদা থান, ধর্মগ্রন্থের মাঝখানে নিকেলের চশমা–মা কি টের পায়, বৌমা ঘুমোয়নি। বৌমা মটকা মেরে শুয়ে থাছে। নিজের সন্তানের কথাও তার এখন মনে পড়ে না! কেমন বিচলিত হয়ে পড়ছে কনকেন্দু।
ঘরে এসে ঢুকতেই সে সুদক্ষিণার ফিসফাস গলা পেল।—এই এস। দরজাটা বন্ধ কর।
বদলা নেবার কথা কনকেন্দুর আর মনে নেই। সুদক্ষিণার আচরণে কেমন এক বেহায়া মেয়েমানুষের আভাস পাচ্ছে। শরীরে কেমন তার বমি বমি ভাব। শরীরটা যে সত্যি মুহূর্তে চুপসে যাচ্ছে। মার সাদা বিছানা, সাদা থান, ধর্মগ্রন্থের মাঝখানে নিকেলের চশমা। মা ঝুমকিকে বুকে জড়িয়ে শুয়ে আছে। তার কিছু ভালো লাগছিল না। ঝুমকিকে বুকে নিয়ে শুতে পারলে আজ যেন তার বেশি আরাম বোধ হত।
কী হল দরজাটা বন্ধ করলে না।
করছি।
সে দরজা বন্ধ করে জল খেল। তারপর খাটে উঠতেই আবার সুদক্ষিণার আবদার, লক্ষ্মী আলোটা জ্বেলে নাও।
কনকেন্দুর চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছে হল। না না, আলো না, আমার ভাল্লাগে রোজ রোজ। কিন্তু সে কিছু বলতে পারে না। যেন বললে সুদক্ষিণাকে অপমান করা হবে। নারী মহিমাকে অপমান করা হবে। নারীর যে আসল রহস্য এবং সরস উর্বরা জমি সে তো কটা বছর—তারপর, সাদা বিছানা, সাদা থান, ধর্মগ্রন্থের মাঝখানে নিকেলের চশমা। সে এসব ভেবেও জোর পাচ্ছে না। তার কোনো ইচ্ছে জাগছে না। আলোটা জ্বালতেও দ্বিধা করছে। যেন আলোটা জ্বালালেই সুদক্ষিণার শরীর বড়ো কুৎসিত দেখাবে। সে কিছুতেই আজ সেটা দেখতে চায় না। সে শুয়ে পড়ে বলল, আজ থাক।
মুহূর্তে সুদক্ষিণা কেমন ক্ষেপে গেল। সে উঠে বসল। নিজে উঠে আলোটা জুেলে, জল খেল। শরীর ঢেকে ঢুকে বলল, আমিতো তোমার কেউ না। আমার জন্য আর তোমার টান নেই। সব বুঝি। আমাকে তুমি একদম ভালোবাস না।
ভালোবাসব না কেন!
না, না, তুমি আমাকে একদম ভালোবাস না!
কনকে আয়নায় সুদক্ষিণার মুখ দেখতে পাচ্ছে। ফুঁসছে সুদক্ষিণা।
কনকে পাশ ফিরে শুয়ে বলল, আস্তে মা শুনতে পাবে। আয়নায় নিজেকে দেখ।
কী দেখব!
দেখই না।
সুদক্ষিণা আয়নায় নিজেকে দেখতেই কেমন ঘাবড়ে গেল। বাইজি মেয়ের মতো তার সাজ গোজ। কনকেন্দুর ঠাট্টা বুঝতে পেরে তার মাথা কেমন আরও গরম হয়ে গেল। সে কাঁপছে। তাকে এত নীচ ভাবে কনকেন্দু। সে ক্ষোভে দুঃখে অপমানে জলের গ্লাসটা পাগলের মতো আয়নায় ছুঁড়ে মারল।
ঝন ঝন শব্দ। কনকেন্দু হকচকিয়ে উঠে পড়ল। এসে জড়িয়ে ধরল সুদক্ষিণাকে। এই ছিঃ কী করলে! কী হয়েছে তোমার। মা, ঝুমকি পাপু ছুটে এসেছে—বাবা বাবা!
মা মা!
কনকেন্দু বলল কিছু হয়নি। হাত থেকে পড়ে কাচের গ্লাসটা ভেঙ্গে গেল। জল খাচ্ছিলাম।
কনকে যখন টের পেল দরজার ও পাশে কেউ নেই, তখন হাত ধরে বলল, ছি এই পাগলামি করার অর্থ কী বলত! তোমার কী হয়েছে।
আমার কিছু হয়নি। আমি তো বাজারে মেয়ে। আমার কী হবে। বলে হাউ হাউ করে কেঁদে দিল।
কনকে আহাম্মক। সে এত বুঝে কিছু করেনি। জড়িয়ে ধরে বলল, এস। ভেতরে তুমি এত ভেঙে পড়বে সত্যি বুঝতে পারিনি।
ছাড় তুমি আমাকে। বাজারে মেয়েকে ছুঁলে তোমার পাপ হবে।
সে এবার নিজেই সুদক্ষিণার বসন আলগা করে দিতে থাকল। জড়িয়ে ধরে বলল, তুমি আমার সতী লক্ষ্মী। তারপর সহবাসে মগ্ন হবার সময় ভাঙা আয়নায় দেখল, তাদের শরীর বড়ো তেড়া-বেতেড়া। এ শরীর যেন কোন এক কালে সুঠাম থাকে—ধীরে ধীরে কাল তাকে এক সময় হরণ করে নেয়।
সকালে ভাঙা আয়নাটা আজ প্রথম সুদক্ষিণা একটা কালো পর্দায় ঢেকে দিল। তারপর চলে গেল মার ঘরে। ঝুমকিকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে এল বাথরুমে। হাত মুখ ধুইয়ে দিল। মুখ মুছিয়ে দিল। যেমন করে একজন মায়ের স্বভাব পড়তে বসানো, টাসক দেখা, চা, দাঁত মাজার ব্রাশ সব ঠিক ঠাক করে দেওয়া, দিনমানের কাজ এ ভাবে সকাল থেকে সুদক্ষিণার শুরু হয়ে গেল।
নারীর অন্য আর এক রূপ আছে। সে জননীই হোক, আর চটুল বাজারে মেয়েই হোক। এটুকু আছে বলেই কনকেন্দুর মনে হয় নারী পুরুষের কাছে এত রহস্যময়ী। চা দিতে এসে সুদক্ষিণা ভাঙা আয়নাটায় দিকে তাকাল না আজ। চোখ টেনে শুধু বলল, তুমিই তো আমাকে ক্ষেপিয়ে দিয়েছিলে। আমার কী দোষ। কেমন সংকোচে এবং লজ্জায় কথাটা বলে বের হয়ে গেল সুদক্ষিণা! আয়নার কালো পর্দাটা তুললেই যেন কনকে আজ এই ঘরে একটা সাদা থান, সাদা বিছানা, ধর্মগ্রন্থের মাঝে নিকেলের চশমা দেখতে পাবে। কনকেন্দুর কেমন একটা ভয় ধরে গেল।
স্বপ্নবৎ
শৈশবে সাঁকো পারাপার ছিল আমাদের প্রিয় খেলা। অবশ্য শৈশব না কৈশোরকাল এখন আর তা ঠিক মনে করতে পারছি না। আমি, কুট্টি মাসি, কুট্টি মামা, ছোটন দাদু সবার ছিল এটা বড়ো প্রিয় খেলা। শীত গ্রীষ্মে মামার বাড়ি যাবার এই এক আগ্রহ ছিল।