সুদক্ষিণা খোলামেলা কথা বলতে ভালোবাসে না। আড়ালে আবডালে সব বুঝিয়ে দিয়েছিল। সানুকে কেন, সে আর এখন নিজেকেও এই ঘরে নিয়ে আসতে সংকোচ বোধ করে।
সুদক্ষিণা বুঝিয়ে দেয়, এই দর্পণে যে প্রতিবিম্ব আছে তা নরনারীর স্বপ্নের পৃথিবী। অথবা রাজকন্যার সেই ভ্রমরের কৌটার মতো। একমাত্র কোনো রাজপুত্রই তা খুলে দেখতে পারে।
তারপর বলেছিল, তবে বল, অন্য কেউ এলে তোমার লজ্জা হয় না। আমার তো হয়।
কনকেন্দুর মনে হয়েছিল, সুদক্ষিণার এই ভাবনা মিছে নয়। তারও হয়েছে। বিয়ের আগে সম্পর্কে এক দাদার বাড়িতে গেলে ঠিক এমনি একটি দর্পণের মুখোমুখী হয়েছিল। দর্পণে সে উলঙ্গ ছবি দেখেছে। মানুষের মগজে যে তরল পদার্থ থাকে তার মধ্যে কত আদ্ভুত সব ছবি যে ভেসে বেড়ায়। দর্পণে বৌদি এবং অন্য কেউ, বৌদিটি তার সমবয়সী, সুন্দরী, ছিমছাম, ঠিক অতসী ফুল ফুটলে যে লাবণ্য থাকে, তার গায়ে ছিল সেই লাবণ্য। সে আয়নার দিকে যতবার তাকিয়েছে এমন ছবি ভেসে উঠেছে। সে মনে করেছিল, এমন সে শুধু একলাই ভাবে। সান কিংবা যে কেউ ভাবতে পারে এটা তার মনে হয়নি। সুদক্ষিণার কথায় টের পেয়েছিল, বাথরুমে কিংবা বেডরুমে আয়না সত্যি বড়ো অশোভন। অথচ এটা সরিয়ে ফেললে কোথায় যেন জীবনের প্রতি একটা বড় অবিচার করা হয়।
কনকেন্দুর এই হয়—একটা থেকে আর একটা। সুদক্ষিণা বিছানায় উঠে হাত পা ছড়িয়ে শুল।
কনকেন্দু বলল, জান শরীরটা ভালো নেই। ঘুম পাচ্ছে।
ঘুমোও না। পাশে শুয়ে ঘুমোও। আমিতো কিছু করছি না।
পাপু যদি এসে ডাকে।
আমরা ঘুমিয়ে পড়েছি। ডাকবে কেন!
জান আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, আজ ওরা ডাকবে।
ডাকলে উঠবে না। দরজা খুলবে না বলছি।
কেন দরজা খোলা যাবে না কনকেন্দু বোঝে। আলোটা না নিভিয়ে শুয়ে পড়েছে যখন তখন তার নিস্তার নেই। নিস্তার কথাটাই মনে এল। কারণ, ক-দিন থেকে রোজ রোজ এই যাত্রার সখিটি তাকে নিয়ে উঠেপড়ে লেগেছে। রোজ সাজা এবং মঞ্চে উঠে আসা। তারপর সায়ার দড়ি আলগা করে রাখা। তার কপালে বড়ো টিপ, সিথিতে চওড়া সিঁদুর—সতীলক্ষ্মী কিংবা সীতা-সাবিত্রীর মতো মুখ। সায়ার দড়ি টেনে খোলার একটা বিশেষ শব্দ হয়। কনকেন্দু তখন যতই অন্যমনস্ক থাকার চেষ্টা করুক, শব্দ রক্তের মধ্যে সহসা ঝড় তুলে দেয়। সে দেখেছে, কখনও যদি আগে শুয়ে পড়ে এবং ঘুম লেগে আসে, বিছানায় ওঠার নামে তাকে ডাকবে।–এই একটু পা দুটো সরাও না। আমি উঠব।
এইসব কথা বলে তাকে জাগিয়ে দেওয়া এমন সব অজুহাতে তাকে সতর্ক করে দেওয়া—যেন যতই ঘুমাও আমি তোমাকে রেহাই দিচ্ছি না।
কনকেন্দু বলল, জান আজ অফিসে একটা কাণ্ড হয়েছে।
কী কাণ্ড!
আমাদের রাধাবাবুর বিরুদ্ধে নালিশ দিয়েছে নীলিমা।
সুদক্ষিণা দুজনকেই চেনে। বিবাহ বার্ষিকীতে একবার তারা এসেছিল। মুখরোচক একটা খবর তখনই সুদক্ষিণা পেয়ে গেছিল।
সুদক্ষিণা পাশ ফিরে শুল। অফিসের কোনো মজার খবর তার এখন শুনতে ভালো লাগছে না। পাশ ফিরে শুয়ে কনকেন্দুর বুকের উপর হাত রাখল।
কনকেন্দু বলল, নীলিমার নালিশ….
সুদক্ষিণা ধীরে ধীরে কনকেন্দুর হাতটা তুলে নিচ্ছে।
কনকেন্দ্র আয়নায় দেখছে, সুদক্ষিণা হাতটা নিয়ে খেলা করছে। উঠে বসেছে। চোখ অলস।
ঝুমকি তখনই দরজায় হুমড়ি খেয়ে এসে পড়ল, ডাকল—মা মা! দাদা আমাকে বিছানায় উঠতে দিচ্ছে না।
সুদক্ষিণা তাড়াতাড়ি শাড়ি দিয়ে শরীর ঢেকে বলল, এই রা করবেন না।
মা শুনছ।
সুদক্ষিণা কনকেন্দুর হাত চেপে ধরছে।
ঝুমকি দরজা ধাক্কাচ্ছে।–মা মা।
কনকেন্দু কী করবে বুঝতে পারছে না। একটা চাদর টেনে সুদক্ষিণার শরীর ঢেকে বলল, কী হল তোদের!
মার গলা তখন, দেখ, পাপু ঝুমকি কী শুরু করেছে!
ঝুমকি বলছে, দাদা আমাকে মেরেছে। আমি দাদার সঙ্গে যোব না। কিছুতেই শোব না।
কনকে উঠে প্রথমে আলোটা নিভিয়ে দিয়ে দরজা খুলল। অন্ধকার ঘরে কনকেন্দু ফিস ফিস করে বলল, চিৎকার করে না। মা ঘুমোচ্ছে। তোমাদের মাকে কত সকাল সকাল উঠতে হয়—এমন করলে চলে। আসলে কনকেন্দু মজা পাচ্ছে। প্রতিশোধটা জববর নেওয়া হচ্ছে। কারণ সুদক্ষিণা এখন কূট কামড়ে পাগল। শরীর তার অলস হয়ে পড়ে আছে। রাগ দুঃখ ক্ষোভ অভিমান সব একসঙ্গে নড়ে চড়ে বেড়াচ্ছে শরীরে। কনকেন্দু মজাটা উপভোগ করতে থাকল। আমার বেলায় একই কষ্ট যেন বলতে চাইল। তখন তুমি অনায়াসে পেট ব্যথা কিংবা ঘুম পাচ্ছে–কখনও হাই তুলে, ইমা—কত রাত হয়ে গেছে, ঘুম না আসতেই সকাল হয়ে যাবে, হাজারটা তোমার অজুহাত। হাত দিলেই তখন তোমাকে বিরক্ত করা হয়। আমার শরীরে তখন এই একই হাজার জোনাকি দপ দপ করে জ্বলে। তুমি সেটা কিছুতেই বুঝতে চাও না।
মা বৌমাকে এ-ব্যাপারে খুব ভয় পায়। বৌমাটির কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে গেলে সংসারে সেদিন নানা রকমের অনর্থ সৃষ্টি হয়। মাথা ধরে। বমি পায়। মা তার নাতনিকে বগলদাবা করে, এই চুপ, তোমাদের মা ঘুমোচ্ছে—কথা বলিস না, লক্ষ্মী সোনা বলে টানতে টানতে দরজার ভেতরে ঢুকিয়ে নিতেই কনকেন্দু ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল, কেমন বেপরোয়া ভঙ্গি পাপুর।-না আমার সঙ্গে শোবে না।
কোথায় শোবে।
আমি কী জানি। আমাকে ও লাথি মারে। ঘুমোতে দেয় না।
কী সব বাজে বকছিস কনকে ধমকে উঠল।
ওর আলাদা বিছানা করে দাও। আমার সঙ্গে ও শোবে না। ও শুলে মাটিতে শুয়ে থাকব আমি।