তোর কী হয়েছে?
কিছুই হয়নি মা। কিছুই হয়নি!
চেঁচাচ্ছিলি কেন!
জানি না। তুমি যাও মা, প্লিজ আমার ঘর থেকে এখন যাও। সে দরদর করে ঘামছিল।
আর তার জেঠুও আছেন। এসেই এক খবর, সঞ্চারী দুই কইবে!
ওমা জেঠুমণি! কখন এলে।
তোর কী খবর?
কোনো খবর নেই।
আর বাবাও আছেন, বড়দা নরেনবাবুরা আর কোনো খবর দিল!
জেঠুমণি কেমন মুখ ফ্যাকাসে করে হাসবেন। সে কাছে থাকলে সত্যি কথাটা বলবেন না। তবে আড়াল থেকে সে ঠিকই টের পায়, পছন্দ না।-তোকে তাপস এত করে বলেছিলাম, বিয়ে দিয়ে দে। লাবণ্য আছে, রেজাল্টও খারাপ না, এটাই সঞ্চারীর বিয়ের সময়।
মেয়ে রাজি না হলে কী করব বলুন।
এখন মেয়ে ধুয়ে জল খাও। চাকরি করবে, চাকরির বাজার কী বুজিস না। সবই তো বুঝি দাদা। চেষ্টা করছি, এম এস-সি পাস করে যদি কোথাও কিছু জোটাতে পারে। কত আশা ছিল। হল কোথায়। দিনদিন রোগা আর খিটখিটে মেজাজের হয়ে যাচ্ছে। আমার সুপারিশে চাকরি হলে, বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবে–ভয় দেখায়।
জেঠু হা হা করে হেসে উঠেছিলেন, পাগল! পাগল! বিয়ের বাজারেও চল সঞ্চারী। তার কিছুই নেই, কেন নেই এই একটা প্রশ্ন। বিয়ে থা দিলেই কি সব ল্যাঠা চুকে যেত! কেন এত কষ্ট করে পড়া! রাত জেগে, স্কুল কলেজের ভাল ছাত্রী হবার বাসনা। কোনো স্বপ্ন। সে যে কী, সে নিজেও ভালো বোঝে না। বিয়ে তো শুধু শরীরের কথাই বলে, মন বুঝবে না! লাবণ্য মানে তো শরীরের চটক, এবং বাথরুমে সে তখন দেখেছে নিজেকে বার বার–তারও যে ইচ্ছে হয় না বললে মিছে কথা বলা হবে। খুবই ইচ্ছে হয়। খুব, খুব। এক আদিগন্ত পৃথিবীর মাঝে কোনো সুনিপুণ কারিগর তার শরীরের রন্ধে রন্ধে খুঁজে বেড়াবে, কোথায় গচ্ছিত আছে তার ভালোবাসা। শরীরে শরীর মিশে যাবে। ভালোবাসাও।
লোকটা এখনও দাঁড়িয়ে আছে।
আচ্ছা বেহায়া মানুষ তো। বাড়িতে যখন কেউ নেই, চলে গেলেই হয়।
লোকটা যে তার কথাতেই এসেছে তাও সে জানে। তার ঠিক বলাও উচিত হয়নি, কাল সন্ধ্যার দিকে আসুন, মা থাকতে পারে।
থাকবেই সে বলেনি। চৌকোনো মতো একটা কাগজের লম্বা বাক্স কালও সঙ্গে ছিল, আজও আছে। এটাই সে ফিরি করে বেড়ায়। কোম্পানির মাল, কিছুতেই হাত ছাড়া করতে রাজি না। ওজনও যথেষ্ট। প্যান্টশার্ট পরা ফিটফাট যুবক। গলার নেকটাইটা নীল রঙের কেন সে জানে না। নীল রংটা তার পছন্দ না। চুল ব্যাকব্রাশ করা। জানালায় দাঁড়িয়ে কথা বলার সময় সে সব লক্ষ করেছে। একবার যখন এসেছে না গছিয়ে ছাড়বে না।
সে কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না। মার জন্য অপেক্ষা করতে পারে। এই রাস্তা দিয়েই ঢুকবে। তার এখন ঘরে ঢুকে বাথরুমে না গেলেই নয়। ঘামে সারা শরীর চ্যাট চ্যাট করছে। সামনে দেখতে পেলেই ঠিক বলবে, গুড ইভনিং আজ আবার এলাম। আপনি বলেছিলেন, সন্ধ্যার সময় আপনার মাকে পাওয়া যাবে।
ধুত্তোরি গুড ইভনিং, একটুও পাত্তা দেবে না। সে চেনে না এমন ভান করবে। রাস্তায় কত লোকই তো দাঁড়িয়ে থাকে। রাস্তার লোকের খোঁজখবর নিতে তার বয়েই গেছে।
সে হেঁটে গেল লোকটার পাশ দিয়ে।
এই যে, দিদি এসে গেছেন, কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি। বাড়িতে কেউ নেই, আপনার মা কি আজও দেরি করে ফিরবেন!
জানি না। বলতে পারত। কিন্তু এই হয়েছে মুশকিল। সে বলতে পারে না। আশ্চর্য রকমের শীতল ব্যবহার করলেও চলে, তাও সে পারে না।
সে গেট খুলে, কোলাপসিবল টেনে ভিতরে ঢুকে গেল। বসার ঘরের দরজা খুলল না, তবে সব জানালা খুলে দিল। লোকটা গেটের মুখে ঢুকে বলল, আসতে ভেতরে।
সে যে কী বলে! যত রাগ এখন মা আর মণিপিসির ওপর। মণিপিসিরও খেয়ে দেয়ে কাজ নেই, নিজে একটা নিয়েছে, সঙ্গে একটা লেজুড় ধরিয়ে দিয়েছে। কী যে খারাপ লাগছে। অচেনা একজন যুবক, বাড়িতে ঢুকে বসার ঘরে অপেক্ষা করলে তার যে বড়ো অস্বস্তি হয়। দিনকাল ভালো না। খবরের কাগজ খুললে সে বুঝতে পারে কতরকমের রাহাজানি ছিনতাই ধর্ষণের ঘটনা যে ঘটে থাকে। সে ইচ্ছে করলেই একজন অপরিচিত যুবককে বলতে পারে না, আসতে পারেন, আমার কোনো অসুবিধা হবে না।
তারপরই কেন যে মনে হল লোকটা নির্বোধ, আসতে পারি’ বলা তার উচিত হয়নি। একা একটা মেয়ে বাড়িতে, আসতে পারি’ বললে কী বোঝায়, তাও কি জানে না! অবশ্য এতসব ভাবনার মধ্যে দরজা খুলে একটা টিনের চেয়ার বাইরে বের করে দিয়ে বলল, বসুন। মা এক্ষুনি চলে আসবে। তারপর সে দরজা বন্ধ করে দিল। সে যথেষ্ট ভদ্রতা করেছে। একজন অচেনা, অজ্ঞাতকুলশীল পুরুষের সঙ্গে এর চেয়ে বেশি ভদ্রতা বজায় রাখা যায় না। বসার ঘরে এনে বসানোও যায় না। পরদা টেনে দিলেই আব্রু ঠিক থাকবে কেন, সে বাথরুমে যাবে, যে কোনো কারণেই হোক বসার ঘর থেকে বাথরুমের জলের শব্দ শোনা যায়। জোরে পাখা চালিয়ে দিলে অবশ্য হাওয়া আর জলের শব্দ মাখামাখি হয়ে যায়। বাথরুমে কী হচ্ছে বোঝা যায় না।
সে বাথরুমে ঢুকে গেল। শরীর থেকে সব খুলে ফেলে শাওয়ার খুলে দিল। কী আরাম! সারা শরীরে সাবান, মুখ উঁচু করে জলের নিম্নগামী ধারার মধ্যে ডুবে যেতে যেতে কেমন মুহ্যমান এক জগৎ, এবং সারা দিনের ক্লান্তি অবসন্নতা ধীরে ধীরে সরে গিয়ে সে সহজেই সতেজ হয়ে উঠতে পারছে।
তখনই ডোর বেল বেজে উঠল। মা বোধ হয় এল!
দরজা খুলে দিলে, মা মেয়েতে ইশারায় বাক্য বিনিময় হয়ে গেল। সেই লোকটা!