তার সালোয়ার কামিজ আশ্চর্য রকমের সবুজ। সে লম্বা এবং তার অনায়াস বিচরণে কিছুটা মুগ্ধতা থেকে যায়। ফেরার সময় সবাই টের পায় সে ফিরছে। শ্যামলা রঙের মেয়ে সে, চোখ মুখে লাবণ্য থাকলেও সে যে দেখতে খুব ভালো না, এটা সে বোঝে। রাস্তায় সে চোখ নামিয়েই হাঁটে। কারও চোখে চোখ পড়ে গেলে তার অস্বস্তি হয়। সে ঠিক সময়ে না ফিরলে মা তার বড়ো উৎকণ্ঠায় থাকে। বার বার রাস্তায় চোখ-সঞ্চারী যদি ফেরে।
সে দূর থেকেই দেখল, গেটের মুখে সেই লোকটা দাঁড়িয়ে আছে। বাড়িতে কি কেউ নেই। মা স্কুল থেকে না ফিরলে কোলাপসিবল গেটে তালা দেওয়া থাকে। তার কাছে ডুপ্লিকেট চাবি থাকে, কেউ না থাকলেও অসুবিধা হয় না। লোকটা গতকালও ঠিক এভাবে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েছিল। সে না বলে পারেনি, কাল আসবেন। বাড়িতে কেউ নেই। মা স্কুলে গেছে, ফেরেনি। বাবার ফিরতে রাত হয়।
এই একটা দোষ আছে তার। কেউ নেই’ কথাটাই যথেষ্ট। মা বাড়ি কখন ফেরে, কি ফেরে না, বাবার ফিরতে রাত হয়, কেন যে বলতে গেল! সে সোজাসুজি বলে দিলেই পারত, আপনার এত আধুনিক ফিল্টার আমাদের লাগবে না। মণিপিসি রেখেছে বলে আমাদেরও রাখতে হবে তার কী মানে আছে!
কিন্তু সোজা কথা সোজা ভাষায় বলতে তার যে আটকায়। এখন ফিরে গিয়ে লোকটার সঙ্গে আবার বক বক করতে হবে। মা বাড়ি থাকলে ঠিক জানালায় দেখা যেত। কিংবা গেট খুলে নোকটা ভিতরে ঢুকে যেত। গেটে তালা দেওয়া, লোকটাই বা যায় কোথায়। মণিপিসিরও খেয়ে দেয়ে কাজ নেই, বাড়ির ঠিকানা, গেরস্থের নাম-সহ লোকটাকে এখানে পার্সেল করে দিয়েছে। কাল মা-বাবা কেউ বাড়ি ছিল
বলে ফিরে গেছে, আজ ফের হাজির। সহজে এরা ছাড়বার পাত্র না। ছিনে জোঁকের মতো লেগে থাকার স্বভাব।
তার মন নিতান্তই ব্যাজার হয়ে গেল। কেন যে মণিপিসি পাঠাল!
আপনার পিসিমা যে বলল, অবশ্যই যাবেন। চিনি বউদিকে বলবেন, আমি রেখেছি। তারপর হাতের লম্বা বাক্সটার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, আপনার মারও খুব ইচ্ছে কেনার। যা দিনকাল, জল খেয়ে পেটের অসুখ লেগেই থাকে। পেট ভুটভাট কত কিছু…।
ইস লোকটা কত খারাপ কথা কত সহজে বলে দিতে পারে। পেট ভুটভাট মানে তার পেটে ভুটভট শব্দ হচ্ছে-জলে নানারকম জীবাণুও এ-বাড়ির জল খাওয়ার অনুপযোগী—সে তো কোনো অসুবিধা ভোগ করে না। মা-বাবাও না। একবার অবশ্য তার জন্ডিস হয়েছিল। সে তো শুনেছে, কোনো কিছুতেই ভাইরাস আটকানো যায় না। অকারণ এই কেনাকাটা তার খুব একটা পছন্দও না। তবু লোকটা দাঁড়িয়ে থাকলে কী করা। কিছুতেই যাবে না। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবে, তবু যাবে না। রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করবে, তবু যাবে না। রাস্তার ধারে বাড়ি বলে এই এক উটকো ঝামেলা। কেউ না কেউ অনবরত দরজায় টোকা মেরে যাচ্ছে— চাই বেডকভার, চাই ভাঙা ছাতা সারানো, চাই বাঁশমতি চাল, চাই শুটকি মাছ। তারপরও আছে, কাগজ আছে মা, কাগজ। ইচ্ছে করলেই দরজা খুলে ভিতরে বসতেও বলতে পারে না। সে একা, কাজের মাসি কাজ করে চলে গেছে। পাশের বাড়ির জানালা থেকে মুখ বাড়িয়ে কেউ কেউ লক্ষও করছিল। সেই লোকটা আবার আজ।
পূজার মরসুম শুরু হয়ে গেছে।
কেনাকাটা থাকে অনেক। স্কুল থেকে ফেরার রাস্তায় হাতিবাগানে একবার টু মারবেই মা। বেশি কেনাকাটা থাকলে দেরি হতেই পারে। বাসে যা ভিড়! ব্যাগ ভরতি শাড়ি সায়া ব্লাউজ, এটা তোর মণিপিসির, এটা তোর সেজপিসির জন্য কিনলাম, আত্মীয়স্বজনদের এই মৌকায় যতটা পারা যায় ফুটানি দেখানো।
আসলে ‘ফুটানি দ্যাখানো’ খুবই রেগে আছে বলে ভাবছে। সেও কম দিতে থুতে পছন্দ করে না। রমাদার জন্য কিনলে না মা। বরং সেই সুযোগ বুঝে কার কেনা হয়নি মনে করিয়ে দেয়। তারপর বাড়ি বাড়ি যাওয়ার মধ্যেও কম আনন্দ থাকে না। তার যে মেলা মাসিপিসি। কাকিমা জেঠিমা। বড়োমামা মেজমামা, রনোদি, মা’র বোনঝি বোনপোও কম নেই। সুতরাং পূজার মরসুমে স্কুল সেরে কেনাকাটা যতটা পারে এগিয়ে রাখে মা। কখনো বাড়ি থাকলে সেও যায়। সেও কাকাকাকিমাদের জামাকাপড় পছন্দ করে কেনে। না গেলেও মা বাড়ি ঢুকেই চেঁচাতে শুরু করবে, সঞ্চারী কোথায় রে! এই দ্যাখ তো, কী রকম হল, তোর দুদুমণির শাড়ি।
চারপাশে তার এত আছে, তবু এই অবেলায় কেন যে মনে হল তার কিছুই নেই। রাস্তার কুকুরের মতোই সে এই সংসারে পড়ে আছে। দিদির বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর সে আরও একলা হয়ে গেল।
কী আছে তার!
সেকেন্ড ক্লাস অনার্স। ফিজিক্স। মনে হলেই যেন কেউ গায়ে তার চিমটি কেটে দেয়। তার ভিতরে জ্বালা ধরে যায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।
হবে না। এত কম নম্বরে হয় না। যাদবপুর, সিট নেই।
বিশ্বভারতী—মাত্র দুটো সিট।
ভাগলপুর যেতে পারে। বাবা রাজি না।
মার এক কথা, তোকে বলছি না, কমপিউটার কোর্সটা সেরে ফেল।
সে লেগে গেল।
তারপর সে কী কবে!
তারপর সে অগত্যা বিটি পড়ছে। লেসন নোট, প্র্যাক্টিস টিচিং, রুশো, ভলতেয়ার, মন্টেসারি, মায় গান্ধি রবীন্দ্রনাথ কিছুই বাদ নেই। চাকরি! শুধু ইন্টারভিউ, বেশি দূর গড়ালে ভাইবা। ব্যাস হয়ে গেল।
তারপর আর খবর নেই। সে রাস্তার কুকুরটার মতোই খোঁড়া, পর্যদস্তু। পারলে বাড়িঘর সব গুড়িয়ে দিতে চায়। সেকেন্ড ক্লাস, সেকেন্ড ক্লাস বলে একদিন অকারণ চেঁচাতে থাকলে মা ছুটে তার ঘরে ঢুকে গেছে।