টুম্পা আরও কেন যে অস্থির হয়ে উঠল।
এই চল।
কোথায়!
আমাকে একটা ট্যাক্সি ধরে দিবি।
এই তো এলি! চল ছোটোকাকার ঘরে। কথা বলবি।
তোর ছোটোকাকা কি মহাপুরুষ!
মহাপুরুষ হতে যাবেন কেন। তোর কথা খুব বলে। এবারে ফিরেই বলেছে, তোর বন্ধুর খবর কি রে, ও আর আসে না।
কেমন এক আশ্চর্য স্নিগ্ধতায় তার শরীর মন ভিজে গেল। নিজের ভিতরেই সে গলে যাচ্ছে—বিনোদিনী রাধার ছবিতে কি তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। ভিতরে সে সত্যি উষ্ণ হয়ে উঠছে।
তবু কি যে হয়, বের হবার মুখে টুম্পা দরজায় উঁকি দিয়ে বলল, যাচ্ছি। আমি বুঝে কিছু বলিনি।
তোমার দোষ হবে কেন। ভিড়ের বাসে সত্যি তো তোমার কষ্ট হচ্ছিল। আমারও উপায় ছিল না। একবার ভাবলাম নেমে পড়ি, ভিড় ঠেলে নামাও যে কঠিন।
টুম্পা বলল, যাই।
তিনি তাকে এই প্রথম দু-চোখ মেলে দেখলেন। আশ্চর্য রোমান্টিক চোখ। পৃথিবীর তাবৎ সুধারসে যেন তিনি উপচে পড়ছেন। চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কঠিন। তিনি যে তার অন্তর্বাস ভেদ করে সব দেখে ফেলছেন বুঝতে এতটুকু অসুবিধা হয়নি।
বাড়ি ফিরে টুম্পা আরও অস্থির হয়ে পড়ল—কেন যে মনে হচ্ছে, তিনি এখনও বোধ হয় লুকিয়ে সেই নগ্ন ছবিতে ডুবে আছেন। শিল্পীর আঁকা সেই মুগ্ধতায় ডুবে যাওয়া ছাড়া তাঁর বোধহয় উপায়ও নেই। মানুষ তো শরীর নিয়েই বাঁচে। মানুষটার কথা যত ভাবছে তত উতলা হয়ে উঠছে।
সে ভালো করে খেতে পারল না পর্যন্ত।
বাবা ফিরে এসে দেখলেন সে শুয়ে পড়েছে। সে শুনতে পাচ্ছে। টুম্পার কি শরীর খারাপ? কি জানি! মা-র কথাবার্তায় অবজ্ঞার সুর।
দরজা বন্ধ করে না শুলে বাবা হয়তো ঘরে ঢুকে কপালে হাত দিতেন। অসময়ে শুয়ে পড়লে বাবা যে ঘাবড়ে যান কেন এত, সে বোঝে না।
তার বড়োই অসময়।
আবার সুসময়ও। কেন যে সব ভেসে যাচ্ছে।
কিন্তু কেউ তো জানে না, সে একেবারে অবিন্যস্ত হয়ে শুয়ে আছে। সে ক্রমশ অতলে ডুবে যাচ্ছিল। হাতড়ে হাতড়ে নিজেকে খুঁজছে, নিজের মধ্যে।
আত্মসম্মান
সঞ্চারী বাস থেকে নেমে গেল। এই স্টপেই সে নামে। গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে সে কাউকে যেন খুঁজছে। শরঙ্কাল, এবং আকাশ নীল অর্থাৎ শরৎকালে যেমনটা হয়ে থাকে। ভ্যাপসা গরম আবার রাতের দিকে ঠান্ডা বাতাসের আমেজ। নাকে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। বাসের ভিড়ে সে কাহিল। তখনই কে যেন বলল, পলার দোকানের দিকে গেল। ওখানে গেলে পাবেন। ওদিকটায় থাকতে পারে।
এই স্টপে পর পর কিছু চা-এর দোকান, ওষুধের দোকান, এমনকী চাউমিন, এগরোলের দোকানও আছে। বড়ো রাস্তা থেকে গাড়ি চলাচলের মতো পাকারাস্তা তার বাড়ির দিকে চলে গেছে। বাসস্টপ থেকে সে হেঁটেই বাড়ি ফেরে। মার স্কুল থেকে এতক্ষণ ফিরে আসার কথা। বাবার ফিরতে রাত হয়। বাবার ছোটাছুটিরও শেষ নেই। হুট করে দিল্লি, বোম্বাই, হায়দরাবাদ কখন যে কোথায় চলে যান, ইউনিয়নের নেতা হলে যা হয়। পেকমিশনের বিরুদ্ধে লড়ালড়ি শেষ। সব দাবিই সরকার মেনে নিয়েছে। লড়াই সার্থক। বাবা আজকাল খুবই প্রসন্নচিত্তে বেশ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরেন। সে বাড়ি ফিরলে কারও আর চিন্তা থাকে না। বাসস্টপে নামলে, সেও ভাবে বাড়ি পৌঁছে গেছে।
যা হয়, শৈশব থেকে সে বড়ো হয়েছে এই এলাকায়। মোড়ের সব দোকানিরাই বাবার দৌলতে তাকে ভালোই চেনে। সে বাস থেকে নেমে এদিক ওদিক তাকিয়ে কী খুঁজছে তারা তাও বুঝতে পারে।
পলার দোকান সামনের খাটাল পার হয়ে দুটো কাঠের গোলাও পার হতে হয়। গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে পলার দোকান দেখা যায়। ইতস্তত রাস্তার কুকুর যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়ায়—পলার দোকানের সামনেও কুকুরের ঘোরাঘুরি আছে। তবে তামাটে রঙের কোনো খোঁড়া কুকুর সেখানে নেই। বাসের চাকায় চাপা পড়ে কুকুরটার অর্ধেকটা পা উড়ে গেছে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে। পায়ে ঘা, শুয়ে থাকলে নীল রঙের মাছির উপদ্রব, কেড়ে কুড়ে খাবার আর ক্ষমতাই নেই। ভালো করে হাঁটতে পারে না, দৌড়তে পারে না, তাকে দেখলেই কুঁই কুঁই করতে থাকে।
কেউ দিলে খায়, না দিলে গাছতলায় লম্বা হয়ে শুয়ে থাকে।
সে কলেজ থেকে ফেলার সময় কুকুরটাকে একটা পাউরুটি খেতে দেয়। কলেজে বাবার সময় টিফিন ক্যারিয়ারের সব খাবারটাই খাইয়ে যায়। কোথায় যে ডুব মারল। আর তখনই কুঁই কুঁই আওয়াজ। পেছনে ফিরে দেখল গাছের গুড়ির আড়ালে মুখ বার করে তাকে দেখছে। তুই এখানে! বলেই কাছে ছুটে গেল। পাটা ফুলে গেছে, শরীর বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে, নড়তে পারছে না। কাল পরশু অথবা তারও পরে, একদিন সে ঠিক দেখতে পাবে কুকুরটা রাস্তায় মরে পড়ে আছে। তার ভিতরে খুবই কষ্ট হচ্ছিল—সে একটা পাউরুটি কিনে ছিঁড়ে ছিঁড়ে মুখের কাছে এগিয়ে দিল। লোকজন তামাশা দেখতেই ব্যস্ত। তার রাগ হচ্ছিল খুব।
অবশ্য সে জানে রাগ করে লাভও নেই। যেমন কেউ বলছিল, তোর এত নরম মন ভালো না রে সঞ্চারী। কেউ বলছিল, রাস্তার কুকুর রাস্তায় মরে পড়ে থাকে, তুই তাকে বাঁচিয়ে রাখবি সাধ্য কী! এরা কেউ কেউ পাড়ার দাদা কাকা, কেউ সমবয়সী, যেমন ‘কেউ বলেই ফেলল, তোর সঙ্গে বাড়িতেই নিয়ে যা। তুই একা থাকিস, মাসিমা খুশিই হবেন।
সে কারও কথার জবাব দিল না। রুটি খাওয়া হয়ে গেলে, সে বটুয়া খুলে কী দেখল। তারপর রাস্তার নেমে গেল। গাছপালা এখনও কিছু আছে, এই রাস্তার কিছু হাইরাইজ বিল্ডিংও উঠে গেছে। পাশের মাঠে গোলপোস্টের কাঠে দুটো কাক বসে আছে, পুকুর থেকে বণিকদের রাজহাঁসগুলি উঠে এসেছে। গলা তুলে রাজনন্দিনীর মতো হাঁটছে। তার মন কঠিন না নরম সে ঠিক বোঝে না, কুকুরটা খেতে পাবে না, না খেয়ে মরে যাবে ভাবতেই তার ভিতরে কিছু একটা তড়িৎ গতিতে প্রবাহিত হচ্ছিল, বোধবুদ্ধি এর নাম হতে পারে, অথবা মায়া, সে যাই হোক, কিছু একটা করা দরকার। মনে হতেই টিফিন বাক্সটা উপুড় করে দিয়েছিল কুকুরের মুখের সামনে। সেই থেকে চলছে।