রড ছেড়ে দিলে লোকটা হয়তো পড়েও যেতে পারে। আবার নাও পড়তে পারে। রড না ধরলেও এত বেশি ঠেস দেওয়া আছে যে লোকটা ঝাঁকুনিতে অনড়ও থাকতে পারে।
ভিড়ের বাসে এই এক জ্বালা।
হাতের ব্যাগটি অবশ্য তার বড়ো সম্বল। স্পর্শকাতর জায়গাগুলি দরকারে আড়াল করার জন্য ব্যাগ থাকলে খুবই সুবিধা। দরকারে হাতের খাতাটি বুকের মধ্যে চেপে রাখে। দরকারে কাঁধের ব্যগটি পেছনের দিকে ঠেলে দেয়। বাবা কাকা মামা মেসো সবার ক্ষেত্রেই আগ্রহটা যে একরকমের সে বোঝে। দোষও দিতে পারে না। মানুষ তো! এমন ভিড়ের বাসে মেয়ে পুরুষ সবাই একসঙ্গে এত গাদাগাদি সহ্য হবে কেন!
সে যতটা পারল পাছা ঘুরিয়ে দিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করছে।
শ্যামবাজারের মোড়ে এসে ভিড়টা পাতলা হল। তবে এখান থেকে বাসটা টপাটপ আরও কিছু যাত্রী তুলে নিল। সিথির মোড়ে না যাওয়া পর্যন্ত বোধ হয় তার রেহাই নেই। সিঁথির মোড়ে গেলে বাসটা প্রকৃতই হালকা হয়ে যাবে সে জানে। এর আগে স্টপে বেস্টপে গাড়ি দাঁড়াবে, প্যাসেঞ্জার তুলবে। না উঠলে ড্রাইভার গড়িমসি করবে বাস চালাতে। গালিগালাজ ওদের গা সওয়া। পাত্তাই দিতে চায় না।
কী যে রাগ হয়।
সর্বত্র এক ধরনের নির্লজ্জ আচরণের সে শিকার।
কাকে দোষ দেবে।
সে পেছন ফিরে আর না তাকিয়ে পারল না। লোকটার অর্ধেক শরীর মুখ দেখা যাচ্ছে। ভালো করে দেখা তার পক্ষেও শোভন হবে না।
‘একটু সরে দাঁড়ান’ বলতেই বাসের সবার কাছে সে লোকটিকে লক্ষ্যবস্তু করে তুলেছে। বেশি কিছু বলে লোকটিকে আর অপ্রস্তুতের মুখে ফেলতে চায় না। হয়তো লোকটির বিন্দুমাত্র সরে দাঁড়াবার জায়গা ছিল না।
প্যাঁচপ্যাচে গরমে সে অনবরত ঘামছে আর মুখ ঘাড় গলা রুমালে মুছে নিচ্ছে।
আর তখনই সামনের স্টপে মোটকা মতো মহিলাটি প্রায় দু-জনের মতো জায়গা ফাঁকা করে নেমে গেল। টুম্পা টুক করে বসে পড়ল।
সে চোখ তুলে তাকাল।
আরে রুবির ছোটোকাকা যে। ছিঃ ছিঃ কী না মনে করল।
সে তো রুবির ছোটোকাকাকে চেনে।
রুবিদের বাড়ি রথতলায়। রুবির জন্মদিনে সে তার ছোটোকাকাকে দেখেছে। লাজুক প্রকৃতির মানুষ। এমনকী রুবি তাকে তার ছোটোকাকার ঘরে নিয়ে গিয়ে আলাপ করিয়ে দিলেও তিনি তাকে চোখ তুলে দেখেননি।
রুবিই বলেছিল কাকা তার মিলিটারির ডাক্তার। শর্ট কমিশনে ছিলেন, পারমানেন্ট কমিশনে যেতে রাজি হননি। চাকরিটা বোধ হয় তার পছন্দ হয়নি। এখন ভাবছেন, এখানেই চেম্বার খুলবেন। কত বয়স মানুষটার!
আর এক বার দেখবে নাকি চোখ তুলে।
ত্রিশ পঁয়ত্রিশ। কমও হতে পারে। আবার বেশিও হতে পারে।
সে তো বাইশ।
ইস কী যে সব ভাবছে। তার নিজের মধ্যেই এক অদ্ভুত দ্বৈত সত্তা পুরুষের জন্য ক্রিয়া করতে থাকে। বয়সের ফারাক নিয়ে মাথা ঘামাতে কেমন সংকোচ বোধ করছে। একদণ্ড আগে কত কুৎসিত চিন্তা মানুষটি সম্পর্কে। একদণ্ড পরে রুবির কাকাকে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠছে। দশাসই চেহারা, দীর্ঘকায়, পুরুষের মতো পুরুষ।
তার দিকে তিনি সেদিন ফিরেও তাকাননি।
এই আমার বন্ধু টুম্পা।
অ। হাত জোড় করে নমস্কার। সে দেখতে কেমন একবার যদি চোখ তুলে তাকাতেন। এত অহংকার।
অপমানের শোধ তুললে কেমন হয়!
সহসাই সে কেন যে বলে ফেলল— আপনি বসুন, জায়গা হয়ে যাবে।
না, ঠিক আছে।
টুম্পা সরে বসে জায়গা করে দিতে চাইছে—কিন্তু তিনি রাজি না।
এসে তো গেছি।
তার বলার ইচ্ছে হল, এসে গেলে কি বসা যায় না। একটুক্ষণ, এই একটুক্ষণেই বড়ো মাধুর্য সৃষ্টি হয় জীবনে, সেটা কি বোঝেন!
মহিলাদের সিটে বসলে কখন না আবার উঠে পড়তে হয় এমন লজ্জাকর পরিস্থিতির কথা ভেবেই হয়তো তিনি তার অনুরোধ রক্ষা করলেন না। সামনের দুটো স্টপের পর তারা দুজনেই নেমে গেল।
টুম্পা তো জানে রুবির কাকা কোথায় যাবেন। কিন্তু তিনি কি জানেন, সে কোথায় যাচ্ছে! শেষে না পেরে বলল, আমি রুবির বন্ধু। আপনি রুবির ছোটেকাকা না!
তাই নাকি, তাই নাকি!
যেন সে একটা বাচ্চা, বড় আদুরে গলায় তাই নাকি তাই নাকি বলতে বলতে নিজের ঘরে ঢুকে গেলেন।
রুবি দৌড়ে এসে কাকার ঘরে উঁকি দিয়ে বলল টুম্পাকে কোথায় পেলে?
ওর নাম বুঝি টুম্পা, কোনো আগ্রহ নেই। বাইশ বছরে যুবতীর পক্ষে এটা যে কত বড়ো অসম্মানের অথবা বড়ো অপমানও বলা যায়, টুম্পা রুবির ঘরে বসে সব শুনে ক্ষোভে জ্বলছিল।
রুবি ঘরে ঢুকে বলল, কি রে টুম্পা, তোর মুখ গোমড়া কেন রে!
কী করে বুঝবে ভিতরে কত জ্বালা তৈরি হয়—এত অবহেলা একটু আলাপ পর্যন্ত না। এত বড়ো মহাপুরুষ তুমি, আসলে সে যে এই মানুষটার খোঁজেই এসেছে—আমার ছোটোকাকা বাড়ি এসেছে শুনেই সে কেন যে ক-দিন থেকে অস্থির ছিল। কোনোও অজুহাতে একবার ঘুরে এলে হয়, বিনোদিনী রাধার ছবি দেখা একটা অজুহাত ছাড়া কিছুই নয়, দু-জনে একসঙ্গে বসে দেখার মজা, কত আর মজা, এ তো বারবার নিজের শরীরকেই দেখা— বিনোদিনী রাধার প্রায় উলঙ্গ শরীর যতই মসলিনে জড়িয়ে জ্যোৎস্নায় ভেসে থাক— সে তো বোঝে এ-শরীর তারই—সব নারীর।
রুবি দু-কাপ চা নিয়ে বসল তার পাশে—
সেন্টার টেবিলে চা রেখে বলল, এক্ষুনি দেখবি না পরে।
টুম্পা কিছু বলছে না।
কি রে, হলটা কি!
সে বলল, আমি উঠব রুবি।
তোর শরীর খারাপ!
জানি না।
জানিস, ছোটোকাকা না লুকিয়ে ছবিটা সকালে বারবারই উলটেপালটে দেখেছে। কারও চোখে না পড়ুক, আমি ঠিক টের পেয়েছি।