বর্ষার বৃষ্টি এই আসে এই যায়।
বাড়ি থেকে বের হবার সময় টুম্পার এমনই মনে হয়েছিল। রবিবারের পাতায় বিনোদিনী রাধার হালকা অনাবৃত ভেসে যাওয়ার ছবিটা সেও দেখেছে—তবে একা, কেন যে সে রুবির অনুরোধ অগ্রাহ্য করতে পারেনি। দু-জনে একসঙ্গে বসে দেখার মজাই আলাদা।
সে বৃষ্টি মাথায় বের হয়ে পড়েছে। বৃষ্টি কিংবা নরম রোদ অথবা বিকেলের ঘোর অন্ধকারে ছাতা মাথায় মেয়েদের এমনিতেই বড়ো রহস্যময়ী মনে হয়। যেন ঘাস ফুল পাখির মতো তারা ঝড়ের বাতাসে উড়ে যাচ্ছে। বাড়ি থেকে বের হবার সময়ও টুম্পার মনে হয়েছিল বর্ষার বৃষ্টি এই আসে এই যায়। রাস্তায় বের হলেই বৃষ্টি উধাও হয়ে যাবে। কারণ মেঘ পাতলা। সূর্য মেঘের ফাঁকে দু-একবার যে উঁকি মারেনি তাও নয়। কেন যে মনে হয়েছিল, এবারে রোদ উঠবে— গানের স্কুল হয়ে রুবির বাড়ি যাবে। রুবি কী এক গোপন সৌন্দর্য তার ঘরে লুকিয়ে রেখেছে, সে গেলে দু-জনে বিকেলের আকাশ দেখতে দেখতে সেই দৃশ্য এবং মগ্নতা দু জনে নিবিষ্ট হয়ে খুঁজে বেড়াবে। কাগজে বিনোদিনী রাধার ন্যুড ছবিটা রুবি তার আলমারিতে লুকিয়ে রেখেছে। রুবির এক কথা, একা দেখতে ভালো লাগে না, তুই এলে দারুণ মজা হবে। নাভির ঠিক নীচটায় হালকা সোনালি রঙের গভীরে হিজিবিজি কি সব দাগ। স্পষ্ট নয়, আভাসে বিস্তীর্ণ মাঠের মতো ছবিটা শাড়ির হালকা আরামবোধে জড়িয়ে আছে। তুই আসবি তো!
এত আশা নিয়ে বসে আছে রুবি, বৃষ্টি বাদলা যাই হোক, আর বসে থাকা যায় না। বর্ষার সৌন্দর্যই আলাদা। গভীর এক মন্ত্রমুগ্ধ দৃশ্যকাব্যের মধ্যে যেন ঢুকে যাওয়া—সে রাস্তায় নেমে বুঝল, বৃষ্টিটা আজ ভোগাবে।
রুবির দাদা সুযোগ পেলেই আড়ালে তাকে দেখে। সেও দেখে। চোখে পড়ে গেলে দু-জনেই কেন যে চোখ নামিয়ে নেয়। আর ভাবে এই তোমার দাদাগিরি! রুবির একটুকু দেরি হলে ধমকাও, কোথায় গেছিলি! এত দেরি। কোথায় যায়, যেতে চায়, বোঝ না।
রুবিকে নিয়ে তোমার এত দুশ্চিন্তা। কী যে ভাব, তাও যদি সে কোনো তার পুরুষ বন্ধুর সঙ্গে ঘুরত। আমরা তো পুরুষ বন্ধু খুঁজছি–সিনেমা নাটকে কবিতাপাঠে কোথায় না। দুর্গোৎসবের মণ্ডপে মণ্ডপে শুধু ওই একজনের আশায়। সে যে আমার সঙ্গ নিয়েছে। যখনই একা নির্জনে বসে থাকি, সেও এসে যায়। তাকে ছাড়া একদণ্ড সময় কাটে না, ভেবেই টুম্পা কেমন ব্যঙ্গ করে ঠোঁট উলটাল। ভিড়ের বাসে কেউ না আবার দেখে ফেলে—সে নিজের মনেই হাসছে, এত কী আশ্চর্য গোপন অভিসার তোর কাগজের পাতায় রুবি। কী আবিষ্কারের জন্য এমন পাগল হয়ে উঠেছিস রুবি।
বাড়িতে টুম্পার এমনিতেই আজকাল কেন যে মন টেকে না। কেমন একঘেয়েমি, ছুতোয় নাতায় সে বাড়ি থেকে বের হয়ে পড়তে চায়। আর বের হলেই কেমন এক হাঁফ ধরা জীবন থেকে যেন তার মুক্তি মেলে।
মাকে বাবাকে মিছে কথা বলতেও আটকায় না—এই যাচ্ছি, ছোটোকাকার বাসায়।
মাঝে মাঝেই সে যেমন রুবির বাড়িতে যায়—ছোটোকাকার বাড়িতেও যায়। কোথাও তার আকর্ষণ না থাকলে সে যায় না।
ছোটোকাকার বাড়িতে সে কেন যায় বোঝে। সেখানে তার একজন মামা আছেন। পদার্থবিজ্ঞানের জাঁদরেল ছাত্র। গবেষণা না কি মুণ্ডু ঘরে বসে সারাদিন দরজা বন্ধ করে চালিয়ে যাচ্ছে। দরজা খুললেই দেখতে পায় এক গাদা বই-এর মধ্যে ডুবে আছেন। তাকে দেখলেই বালকের মতো খুশি হয়ে ওঠেন তিনি। তবু সম্পর্কে মামা বলেই গম্ভীর চালে কথাবার্তা বলেন— তার পরীক্ষার প্রিপারেশান নিয়েই কথাবার্তা বেশি, সে গেলে গবেষণার চেয়ে এই দূর সম্পর্কের আত্মীয়াটির প্রতি যে ক্রমশই বেশি আগ্রহ বোধ করছেন, টের পায় টুম্পা। যতই নির্দোষ আলোচনা হোক, টুম্পা তার শাড়ি সামলাতেই ব্যস্ত থাকে।
বাসটা যাচ্ছে।
বাসের ভিড়ও বাড়ছে।
ঠোঁটে তার আবার মজার হাসি ফুটে উঠছে। একবার পরীক্ষায় বসলে হত। আজ পর্যন্ত একজন পুরুষ মানুষকেও বাজিয়ে দেখা হল না। এই শারীরিক পরীক্ষা আর কি। কেউ বাসায় নেই। সে গিয়ে যদি কোনোদিন একা আবিষ্কার করে ফেলে মামাকে, তখন তাঁর আচরণ কেমন হয় এমন কোনো পরীক্ষায় যদি মানুষটাকে ফেলে দেওয়া যায়। ইচ্ছে করলে মানুষটার ভালোমানুষের জারিজুরি নিমেষে হাওয়া করে দিতে পারে।
সে যায় সেই কারণে।
মগজে তাঁর এই সব ছবিই বেশি ভাসে। এই সব অলস ভাবনায় সে তাড়িত হয় বলেই ঘরে তার মন টেকে না। রুবির কাছে যাওয়া এই গোপন অভিসারেও মজা কম না। কাগজের একটা নড় ছবি কী আছে—বাথরুমে সে যখন নিজেকে আবিষ্কারে মত্ত থাকে তখনও শরীরে সে যে কী খুঁজে বেড়ায় বোঝে না। এত রহস্যময় শরীর নিয়ে সে যে কী করে।
তার তো বয়স বেশি না। এই কিছুদিন হল ফ্রক ছেড়েছে। ম্যাকসি পরত। বাড়িতে কোনো পুরুষ আত্মীয় এলে ম্যাকসি পরে ঘুরে বেড়ানো বাবা-মার পছন্দ না। সে শাড়ি না পরলে বাবা গুম মেরে যেতেন। তার দিকে তাকাতেনই না। তারপর কিছুদিন সালোয়ার কামিজ-তারপর শাড়ি পরতেই সে কেমন হালকা হয়ে গেল। হালকা হয়ে গেল ঠিকই, তবে চলাফেরায় অস্বস্তি। বাসে ট্রামে সালোলায়ার কামিজে খুব সুবিধে। তবে তাকে নাকি শাড়িতেই বেশি সুন্দর দেখায়।
বাসটা চলছে।
বাসটা থামছে।
বাইরে টিপটিপ বৃষ্টি তেমনই পড়ছে।
কন্ডাকটার হাঁকছে, পরেশনাথের গেট।